ইতোমধ্যেই প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করেছে। গাছে গাছে নতুন ফুল ও পাতা গজাতে শুরু করেছে। বাতাসের বিভিন্ন ফুলের মধুর ঘ্রাণ। সিডনির মাউন্ট এনানের বোটানিক গার্ডেনের দর্শনার্থীরা।
পঞ্জিকা অনুসারে ১ সেপ্টেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়াতে শুরু হবে বসন্তকাল। কিন্তু ইতোমধ্যেই প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করেছে। গাছে গাছে নতুন ফুল ও পাতা গজাতে শুরু করেছে। বাতাসের বিভিন্ন ফুলের মধুর ঘ্রাণ। মৌমাছি ও পাখিদের ব্যস্ততা বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন সাবার্বে বোটানিক গার্ডেন আছে। বসন্তের আগমনে সেগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে।
অনেক বোটানিক গার্ডেনে বসন্তকাল সামনে রেখে আলাদাভাবে কিছু ফুলের গাছ লাগানো হয়। যেগুলো বসন্তে ফুল দিয়ে আবার মরে যায়। সিডনির মাউন্ট এনান বোটানিক গার্ডেনে প্রতি বছর বসন্তকাল আসার আগেই বেশ কয়েকটা বেডে পেপার ডেইজি ফুলের বীজ বুনে দেওয়া হয়। সেগুলো বসন্তকাল আসতে আসতে বেড়ে উঠে। এরপর এক সময় বর্ণিল রঙে ডেইজি ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে।
ডেইজি ফুলগুলো দেখতে ঠিক তারার মতো। সাদা, লাল, হলুদ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। ডেইজি বেডগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, যেন আকাশের তারাগুলো খসে এই বেডে এসে পড়েছে। আর বিভিন্ন বর্ণে সেজে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ফুলগুলোর দিকে তাকালে আর দৃষ্টি ফেরানো যায় না। যতই দেখবেন ততই আপনার দেখার আগ্রহ বেড়ে যাবে। গত ২৭ আগস্ট বিকেলে আমি আর আমার ছেলে রায়ান হাজির হয়ে গেলাম তাদের কাছে।
বসন্তে মৌমাছি ব্যস্ত সময় পার করছে।
অন্যান্য সময় যাওয়া হলেও প্রতি বছর এই সময়টায় অন্তত একবার হলেও বোটানিক গার্ডেনে আমাদের যাওয়া চাইই চাই। এইবার যেতেই মনে হলো, ডেইজি ফুলগুলো আমাদের দেখে হেসে উঠল। অনেক মানুষ এসেছেন এই সৌন্দর্য দেখতে আর ফুলের রঙে নিজেদের মনকে রাঙিয়ে নিতে। একজন ভদ্রমহিলা বিভিন্ন অবস্থান থেকে ছবি তুলছেন দেখে আমি বললাম, ‘আসলে ছবি তুলে শেষ করা যাবে না।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘ঠিক তাই, এগুলোর সৌন্দর্য আসলে ক্যামেরায় ধরা সম্ভব নয়।’
তারার মতো ফুটে আছে রাশি রাশি পেপার ডেইজি।
আরেক বয়স্ক দম্পতিকে দেখলাম একজন অন্যজনের ছবি তুলে দিচ্ছেন। আমি প্রস্তাব করলাম, ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদের যুগল ছবি তুলে দিতে পারি।’ আগ বাড়িয়ে সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া অস্ট্রেলিয়ার খুবই স্বাভাবিক একটা সৌজন্যতা। আমার প্রস্তাবে তারা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। ছবি তুলে দেওয়ার পর তারা আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।
জানালেন, তারা পাশেই থাকেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি সকালবেলায় হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলি আসি। তখন এত ভিড় থাকে না। ধীরেসুস্থে সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়।’
বসন্তে ফুটেছে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ফুল জেমি লিলি।
এরপর আমরা বাগানের অন্যান্য অংশে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। রায়ানের ক্ষুধা পেয়ে গিয়েছিল। তাই বাগানের ভেতরে অবস্থিত একমাত্র ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলাম। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ আমাদের ২ জনকে চেনেন। সেদিনও একজনকে পেয়ে গেলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগেরবার যখন দেখা হয়েছিল, তুমি বলেছিলে বিয়ে করছ। করেছ?’ উত্তরে মেয়েটি বললেন, ‘হ্যাঁ, গত মে মাসেই।’ তারপর তিনি তার বিয়ের ছবি দেখালেন, সবার পরিচয় দিলেন। রায়ানকে দেখে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি আইসক্রিম নিতে এসেছ? যাও ফ্রিজ খুলে তোমার পছন্দমত বের করে নাও।’ আইসক্রিমের দাম দিতে গেলে তিনি কোনোভাবেই নিতে রাজি হলেন না।
সিডনির মাউন্ট এনানের বোটানিক গার্ডেনের পেপার ডেইজি বেড।
তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে আবার আমরা ডেইজি ফুলের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ২ জন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আমাদের পাশাপাশি হাঁটছিলেন। একজন অন্যজনকে ফুলের নাম জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি পাশ থেকে উত্তর দিলাম, ‘ওইগুলোর নাম পেপার ডেইজি।’ শুনে তারা খুবই খুশি হলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমরা আবারও ডেইজি ফুলের কাছে ফিরে গেলাম। দেখলাম তারাও ছবি তুলছেন। আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ছবি তুলে দিতে পারি।’
আমার কথা শুনে তারা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। ছবি তুলে দেওয়ার পর তা দেখে তারা কিশোরীদের মতো খুশি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘জানেন, আমরা ২ জন সেই প্রাথমিকের ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধু। যদিও এখন জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমরা অনেক দূরে থাকি, কিন্তু বছরে অন্তত একটাবারের জন্য হলেও দেখা করি। তোমাকে ধন্যবাদ আমাদের এইবারের দেখাটা স্মরণীয় করে দেওবার জন্য।’
বসন্তে বেড়ে গেছে পাখিদের ব্যস্ততাও।
তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমরা পাশের হ্রদের দিকে হাটা শুরু করলাম। সেখানে কয়েকটা টিয়া ও ঘুঘুপাখি একসঙ্গে খাবার খাচ্ছিল। খুব কাছাকাছি গিয়ে তাদের ছবি তুলে নিলাম। হ্রদের পানিতে হাঁস ও ডাহুকরা শেষ বেলায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। আমরা হ্রদের পাশের সবুজ ঘাসে আধশোয়া হয়ে বসে পড়লাম। রায়ান খুশি মনে একেবারে শুয়েই পড়ল। হঠাৎ আকাশের দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখি সেখানে গাড় নীল আকাশে সাদা মেঘের আল্পনা। আর তার মাঝেই সাদা চাঁদমামা আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে। জল, স্থল আকাশ, বাতাস সবখানেই বসন্তের মাতাল বাতাস বইছে।