বর্ষাকাল এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কক্সবাজারে পর্যটক কমে গেছে। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দুঃসময় পার করতে হচ্ছে।
কক্সবাজারে সাধারণত অক্টোবর মাস থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হয়ে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত চলে। এই সময় সৈকতের বালিয়াড়ি ও আশপাশের পর্যটনস্পট লোকারণ্য থাকে। ব্যবসায়ীরা জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যায় এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রতিটি পর্যটনখাত লাভবান হয়।
যখন বছরের পর্যটন মৌসুম শেষ হয়ে যায়, তখন ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক কষ্টে পড়ে। বিক্রির অভাবে অনেকে হিমশিম খায়। এমনকি, কখনও কখনও পর্যটনস্পটে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছায়। এতে ব্যবসা হয় না। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় ছোট থেকে শুরু করে বড় পুঁজির ব্যবসায়ীরাও।
এখন চলছে আগস্ট মাস। বলা হয়ে থাকে ‘অফ সিজন’। তাছাড়া সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে এবং সাগর উত্তাল। কক্সবাজারে বেড়ানোর জন্য যে কয়েকটি সাগরঘেঁষা স্পট রয়েছে, তাতে ঢেউয়ের ধাক্কা আর জোয়ারের পানিতে সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। অপরদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কক্সবাজারে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে সৈকত নগরীতে পর্যটকের পদচারণা তেমন নেই। সারা দিন খোলে রেখেও বিক্রি হচ্ছে না এমন বহু দোকান রয়েছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে।
হোটেল-মোটেল, কটেজে ভাড়া নেই। ব্যবসায়ীদার চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
সুগন্ধা পয়েন্টের একাধিক ঝিনুক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎস সুগন্ধা বিচের এই ছোট্ট ব্যবসা। পর্যটন মৌসুমে ব্যবসা হলেও যখন সিজন অফ থাকে, তখন ছেলে-মেয়ের স্কুলের খরচ তো দূরের কথা; সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। পর্যটন মৌসুম শেষ হয়ে গেলে আমাদের মধ্যে কেউ দোকানপাট বন্ধ করে ইজিবাইক (টমটম), সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়।’
সুগন্ধা পয়েন্টের মুজিব মুক্তা হাউসের মালিক মোবারক বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে সুগন্ধা বিচে ব্যবসায় করে আসছি। কিন্তু এ বছরের মতো কম পর্যটক আগে কখনও দেখিনি। সকাল থেকে দোকান খুলে এখনও (দুপুর পর্যন্ত) বিক্রি হয়নি। তারপরও দোকানটা খুলে বসে আছি।’
ওই পয়েন্টের ঝিনুক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রুবেল খান বলেন, সুগন্ধা পয়েন্টে ঝিনুক মার্কেটের উপর নির্ভর করে ৩৮০টি দোকানের প্রায় ৫ হাজার পরিবার চলে। পর্যটন মৌসুমে তাদের দিন ভালো গেলেও মৌসুম শেষ হওয়ার পর অভাবে পড়ে যায়। কারণ তারা দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো ব্যবসায়ী। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে তাদের উপার্জন থেকে সঞ্চয় কিংবা জমা রাখার সুযোগ থাকে না। তাই পর্যটনের খরা সময়ে তারা সংসার চালাতেও অসুবিধায় পড়ে যায়।
একই পয়েন্টের ড্রাগন মার্কের বিপরীতে ‘ফিস ফ্রাই’ দোকানের মালিক সালমান হোসেন বলেন, ‘রাস্তার ধারে ফ্রাই করা মাছ বিক্রি করে ৬ সদস্যের সংসার চালাই। পর্যটকের আনাগোনা বেশি থাকলে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পাই। কিন্তু যখন সৈকত পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে, তখন বিক্রিহীন এমনও অনেক দিন যায়। বিক্রি একদম না থাকলে শহরের ভেতর গিয়ে ভ্যান গাড়ি নিয়ে আমড়া ও নানা ধরনের ফলমূল বিক্রি করি।’
মেরিন ড্রাইভ রোড ইনানী বীচ পয়েন্টের ইনানী বিচ ক্যাফে এন্ড রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পর্যটনের ভরা মৌসুমে ব্যস্ত সময় কাটে আমাদের। কিন্তু যখন মৌসুম শেষ হয়, তখন অর্থনৈতিকভাবে কষ্টে পড়ে যাই। দোকানের ১৫ জন স্টাফ থেকে ছাটাই করে ৬ কিংবা ৭ জন রাখতে হয়। তাদের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হয়। সর্বনিম্ন প্রতি জনের বেতন ৮ হাজার টাকা। রাঁধুনীর বেতন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অফ সিজনে তাদের বেতন দিতে কষ্ট হয়। এমনকি পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণ বিক্রি করে তাদের টাকা পুষিয়ে দিতে হয়। ঠিক এখন সেই সময় চলছে। পর্যটক না থাকায় কষ্টে দিন যাপন করছি।’
করোনা মহামারিতে এরকম পর্যটক খরায় ভুগেছিল কক্সবাজারের প্রতিটি পর্যটন স্পট। তখন পর্যটনখাতে যে বিরাট ক্ষতি সাধন হয়, তা এখনও পুষিয়ে উঠতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। তবে অক্টোবরের শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অসংখ্য পর্যটক কক্সবাজারে আসবে এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করবে বলে আশা করছেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের ‘আমান ভাইয়ের আনন্দ চটপটি’ দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. আমান বলেন, ‘আমরা যারা সৈকতে ব্যবসা করি, তারা পর্যটন মৌসুমে স্বস্তিতে থাকি। অফ সিজনে আমাদের বিক্রি তেমন হয় না। পর্যটন মৌসুম শেষ হয়ে গেলে সংসার চলাতেও হিমশিম খেতে হয়। কষ্ট হলেও পুরনো পেশা হিসেবে ধৈর্য ধরে থাকি।’
ওই পয়েন্টের পান বিক্রেতা সেলিনা খাতুন বলেন, ‘পান বিক্রি করে সংসার চালাই। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কামাই করতে পারলেও এখন পর্যটক নেই, পান খাওয়ার লোকও নেই। অভাবে যাচ্ছে সময়।’
ঘোড়া নিয়ে মলিন চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে সমিতিপাড়ার মেহেদী। তিনি বলেন, ‘সারা দিনের ইনকাম ৪৫০ টাকা। বৃষ্টির দিন, কেউ ঘোড়ায় চড়তে চায় না। তাছাড়া পর্যটকও নেই। পর্যটন মৌসুমে দৈনিক ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ইনকাম করতে পারি। এখন ঘোড়ার খাদ্যের টাকাও জোগাড় করতে পারছি না।’
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম নেওয়াজ বলেন, ‘অন্যান্য মাসের চেয়ে এই মাসে কক্সবাজারে পর্যটক খুবই কম। সব হোটেলে পর্যটকের সংখ্যা হিসেবে করলে দেখা যাবে ২০ শতাংশের ওপরে পর্যটক নেই। সারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ। সাগর উত্তাল এবং সতর্ক সংকেত, বৃষ্টি এবং চট্টগ্রামের বন্যা সব মিলিয়ে পর্যটকরা আসতে পারছে না কক্সবাজারে। ফলে পর্যটনখাতে ক্ষতি হচ্ছে। অনেক পর্যটন ব্যবসায়ী কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।’
অমৌসুমে দোকানপাট বন্ধ থাকলে সৈকতপাড়ের পর্যটন ব্যবসায়ীরা কীভাবে সংসার চালায় এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম নেওয়াজ বলেন, সরকার অনেক ব্যবসায়ীকে ক্ষুদ্র ঋণদানের মাধ্যমে নানান ধরণের ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। এসব ঋণের মাধ্যমে তারা পর্যটন ব্যবসা বন্ধ থাকলে অন্য ব্যবসা করে পরিবারের অভাব মোচন করতে পারে।
তবে পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ পর্যটনসেবার নিশ্চয়তা থাকলে দেশীয় ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের আগমন বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার শেহরীন আলম বলেন, ‘কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের সেবাদানের জন্য আমাদের একাধিক টিম নিয়োজিত রয়েছে।’