সাজেকের পথে পথে

অবশেষে মার্চের ৪ তারিখ সেই দিনটি এলো। লক্ষ্য সাজেক ভ্রমণ। রাত ১১:৪০ এ সেন্টমার্টিন পরিবহনে কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। সামনের সারিতেই আমাদের পছন্দের সিট। লম্বা চুলের দীর্ঘদেহী বেশ হ্যান্ডসাম এক ড্রাইভার আমাদের নিয়ে চললেন। দারুণ উচ্চারণে কথা বলেন। ভাবগম্ভীর। কথাবার্তায় শিক্ষিত বলে মনে হলো। গাড়ি ছাড়ার ঘণ্টাখানেক পরেই প্রায় সব যাত্রীর শুরু হলো ঘুমপর্ব। আমি জেগে। রাতের রাস্তা দেখতে ভালো লাগে। ভোর প্রায় ৪:৩০ মিনিটের দিকে আমরা রামগড় পৌঁছলাম। হঠাৎই মনে হলো সবাই জেগে উঠেছে। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই গাড়ি একবার ডানে একবার বামে মোড় নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল প্রতি মিনিটে মিনিটে গাড়ি তার দিক পরিবর্তন করে চলছে। বোঝা গেল সমতল হলেও আমরা বেশ আঁকাবাঁকা পথে প্রবেশ করেছি। এ সময় ড্রাইভার সাহেবের গাড়ি চালানোর কারিশমা দেখলাম। অপজিট সাইড থেকে যেহেতু খুব কম গাড়ি আসছিল, তাই ভয়টা কম অনূভুত হলো। এরই মধ্যে যথারীতি মেয়ে তার বমি পর্ব সম্পন্ন করলো। ওর জন্য পর্যাপ্ত পলিথিন আর পানির ব্যবস্থা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ সব যথাসময়ে প্রস্তুত রাখি। মেয়ে বমির ধকল কাটিয়ে শান্ত হলো। পুব আকাশে আলো ফুটতেই খাগড়াছড়ি পৌঁছলাম। ‘অরণ্য বিলাস’ নামের এক হোটেলে উঠলাম।

jagonews24

দুপুরে গেলাম পানছড়ি উপজেলায় এক চাকমা বাড়িতে। হৃদয় চাকমা নামক এক ব্যক্তি আমাদের পূর্বপরিচিত। ছোট্ট এক পাহাড়। তার উপর বাড়ি। বাড়িতে অনেক ঘর। দেখে বুঝতে পারলাম এটি যৌথ পরিবার। বাচ্চাদের জন্য পথে মিষ্টি কেনা হয়েছিল। হৃদয় চাকমার পরিবারের সব সদস্য ভীষণ রকমের অমায়িক আর হাসিখুশি। আমাদের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। আমরা যাওয়ামাত্র অপেক্ষাকৃত ছোট বয়সের সব শিশু-নারী-পুরুষ পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আমরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। পরক্ষণে বুঝলাম, এটি বড়দের প্রতি ওদের শ্রদ্ধা প্রকাশের প্রথাসিদ্ধ রীতি। আমরা চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। নিরিবিলি আর গাছগাছালিতে ঘেরা ছিমছাম পরিবেশ। সারি সারি মাটির ঘর। শুনেছি মাটির ঘরে না-কি তেমন গরম লাগে না। সত্যি তাই।

ভরদুপুরে তেমন গরম লাগলো না। যদিও টেবিল ফ্যানের ব্যবস্থা ছিলো। বাড়ির পাশেই নানা রঙের অনেকগুলো জবাফুলের গাছ চোখে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আমরা খেতে বসলাম। টেবিলে দেয়া হলো ছয়-সাত পদের খাবার। এর অধিকাংশ তাদের নিজস্ব খাবার। মাটির নিচের একধরনের আলু দিয়ে লইট্টা শুঁটকি, ডাটা দিয়ে চিংড়ি, খাসির গোশত, মুরগি, ডিমের তরকারি, চিচিঙ্গা দিয়ে ডাল চরচরি, বাঁশে রাঁধা বিন্নি চালের ভাত। সবশেষে পেঁপে, পায়েস, দুধ, রং চা আসতে লাগলো। এতো এতো আয়োজনে লজ্জায় পড়তে হলো আমাদের। চাকমা পরিবারটি স্বচ্ছল নয় কিন্তু পরিশ্রমী। দেখলাম এদের মেয়েদের চোখেমুখে অক্লান্ত পরিশ্রমের ছাপ। ওদের আয়ের তেমন কোনো উৎস নেই। চামড়া কুচকানো, কপালে গভীর বলিরেখা কিন্তু মুখে সরল একটি হাসি। তবে পড়াশোনার ব্যাপারে সচেতন। আমাদের পেয়ে পরিবারের সবাই খুব আনন্দিত। কেউ স্যান্ডেল এগিয়ে দিচ্ছে, হাত ধোয়ার পানি দিচ্ছে। আতিথেয়তার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখলাম ওদের আন্তরিকতায়। খাওয়া শেষে সবাই আমাদের সাথে ছবি তুললো। গৃহকর্তা বাড়িতে রাত্রিযাপনের নিমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু আমাদের সময়গুলো তো হিসেব করা। তাই তাদের নিমন্ত্রণ ইচ্ছে থাকলেও গ্রহণ করা গেলো না। বিদায় জানাতে প্রায় পরিবারের সবাই আমাদের সাথে অনেকদূর এগিয়ে এলো। বিদায়ের মুহূর্তে জড়িয়ে ধরলো। কী এক মমতায় বেঁধে ফেললো অল্প সময়ের মধ্যেই। চাকমা পরিবারটির কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে।

নাসরীন আক্তার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: