সিনেমাজগৎ নিয়ে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, শুধু তারকারা অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করেন। সিংহভাগ সময়ই কোনো চলচ্চিত্রদলে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক অভিনেতারাই পান। তবে শীর্ষস্থানীয় পরিচালকরাও এক্ষেত্রে খুব একটা নেই। সত্যি বলতে কী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী চলচ্চিত্র সেলিব্রিটি কিন্তু কোনো অভিনেতা নন, বরং একজন চলচ্চিত্র পরিচালক।
এই সেলিব্রিটি ৯৪০ কোটি ডলার সম্পত্তির মালিক। যদিও তিনি জীবনে মাত্র ছয়টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। গত ২০ বছরে তিনি কোনো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেননি।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী চলচ্চিত্র সেলিব্রিটি ‘স্টার ওয়ার্স’ ও ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ ফ্র্যাঞ্চাইজির স্রষ্টা জর্জ লুকাস।
ব্লুমবার্গ-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের অক্টোবর হিসাবে লুকাসের সম্পত্তিরর পরিমাণ ৭৭০ কোটি ডলার। অন্যান্য সূত্র অনুযায়ী, তার সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি—৯৪০ কোটি ডলার পর্যন্ত।
জর্জ লুকাস সমসাময়িক যেকোনো তারকার চেয়ে অনেক ধনী। সম্পত্তির দিক থেকে তিনি জে জেড, ম্যাডোনা, টেলর সুইফট ও রিহানা-কে পিছনে ফেলেছেন।
মজার ব্যাপার হলো, পরিচালক হিসেবে পরিচিত জর্জ লুকাস জীবনে মাত্র ছয়টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে: ‘টিএইচএক্স ১১৩৮’ (১৯৭১), ‘আমেরিকান গ্রাফিতি’ (১৯৭৩), এবং ‘স্টার ওয়ার্স’ ফ্রাঞ্চাইজের চারটি ছবি—যার মধ্যে ১৯৭৭ সালের প্রথম চলচ্চিত্র ও প্রিক্যুয়েল ট্রিলজি রয়েছে।
১৯৭১ সালে ২৭ বছর বয়সে ‘টিএইচএক্স ১১৩৮’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন জর্জ লুকাস। ছবিটি স্লিপার হিট হয়—অর্থাৎ শুরুতে তেমন আশা জাগাতে না পারলেও পরে ধীরে ধীরে সাফল্য পায়। এর দুই বছর পর তার পরিচালনায় ‘আমেরিকান গ্রাফিতি’ও হিট হয়। তবে লুকাস খ্যাতির তুঙ্গে ওঠেন ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ব্লকবাস্টার ‘স্টার ওয়ার্স’ দিয়ে।
জর্জ লুকাস সর্বশেষ পরিচালনা করেন ‘স্টার ওয়ার্স: এপিসোড থ্রি—রিভেঞ্জ অভ দ্য সিথ’ ছবি। এটি ২০০৫ সালে মুক্তি পায়।
জর্জ লুকাসের সম্পত্তির পরিমাণ কত
জর্জ লুকাস কতটা ধনী, তা বোঝার জন্য বিশ্বের আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ধনী সেলিব্রিটির সঙ্গে তার সম্পদের তুলনা করা যেতে পারে।
কমিয়ে হিসাব করলেও জর্জ লুকাসের সম্পত্তির পরিমাণ (ফোর্বস অনুসারে ৫৩০ কোটি ডলার) টেলর সুইফট (১৩০ কোটি ডলার), টম ক্রুজ (৮০ কোটি ডলার) ও শাহরুখ খানের (৮৭ কোটি ডলার) মোট সম্পত্তির চেয়েও বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অভিনেত্রী জামি গার্টজের সম্পত্তির পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলার। তবে তিনি এই সম্পত্তি অর্জন করেছেন ব্যবসা ও ক্রীড়া ক্ষেত্র থেকে। অন্যদিকে লুকাসের সম্পত্তির পুরোটাই এসেছে বিনোদন জগত থেকে।
যেভাবে এত সম্পত্তির মালিক জর্জ লুকাস
ছয়টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করলেও জর্জ লুকাস সবচেয়ে বড় দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজ ‘স্টার ওয়ার্স’ ও ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’-এর স্রষ্টা ও প্রযোজক।
‘স্টার ওয়ার্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। এ আয়ের মধ্যে পণ্য বিক্রি ও বক্স অফিসের আয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফ্রাঞ্চাইজের স্রষ্টা হিসেবে জর্জ লুকাস এখানে থেকে বড় অঙ্কের রয়্যালটি পেয়েছেন। অন্যদিকে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ ফ্র্যাঞ্চাইজের মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।
এছাড়া ভিডিও গেম লাইসেন্সার লুকাসআর্টস, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট কোম্পানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট অ্যান্ড ম্যাজিক এবং অডিও কোম্পানি ‘টিএইচএক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ লুকাস। এই সফল ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোও তার সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বাড়িয়েছে।
লুকাস ‘স্টার ওয়ার্স’-এর মেধাস্বত্ব ‘ডিজনি’র কাছে বিক্রি করেছিলেন। তবে এখনও এ ফ্রাঞ্চাইজ থেকে তিনি রয়্যালটি পান। ‘স্টার ওয়ার্স’-এর আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রের কাজ চলছে। ফলে তার সম্পত্তি আরও বাড়াতে পারে।
চলচ্চিত্র জগতে অবদান রাখার জন্য বহু পুরস্কার পেয়েছেন জর্জ লুকাস। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবের মর্যাদাপূর্ণ ‘অনারারি পাম ডি’অর’ পুরস্কার।
সাফল্যের নেপথ্যে
জর্জ লুকাসের এই সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার শক্তিশালী নেতৃত্বগুণ, ভিশন এবং সেই ভিশনকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য বুদ্ধিমান মানুষদের পরিচালনা করার ক্ষমতা এর অন্যতম কারণ।
জর্জ লুকাসের প্রযোজনা কোম্পানি লুকাসফিল্মে বিভিন্ন বিভাগ প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিলে কাজ করতে। যেমন, কম্পিউটার বিভাগ স্পেশাল ইফেক্ট বা গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করত।
লুকাসফিল্মের ভিএফক্স ও অ্যানিমেশন স্টুডিও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট অ্যান্ড ম্যাজিকেও কর্মীদের নির্দিষ্ট কোনো কাজ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হতো না। ফলে তারা কোনো নির্দিষ্ট বিভাগের কাজে আটকে থাকতেন না। কোম্পানিটির কর্মীরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজের দায়িত্ব পেতেন। এভাবে জনবলকে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন ভীষণ সাহসী হওয়া, যা লুকাসের ব্যক্তিত্বের ট্রেডমার্ক।
ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস শিল্পী ক্লিন্ট গোল্ডম্যান ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে সাত বছর ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট অ্যান্ড ম্যাজিকে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘জর্জ এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যা অনেকটা বিজনেস আর্ট স্কুলের মতো, যেখানে মানুষ একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারত।’
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডয়ী এবং লুকাসের সাবেক কর্মী ফিল টিপেটের মতে, জর্জ লুকাস এমন একটি ভাষা গড়ে তোলেন, যা প্রায় টেলিপ্যাথির মতো।
‘দ্য ইয়াং ইন্ডিয়ানা জোনস ক্রনিকলস’-এর প্রযোজক রিক ম্যাককালাম লেখক মাইকেল রুবিনকে বলেছিলেন, একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে করতে লুকাসফিল্মের কর্মীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়, যা সাধারণ সহকর্মীদের মধ্যে বিরল। তাদের এই বন্ধন পুরো কর্মজীবনজুড়ে টিকে থাকে।
লুকাসের মুভি র্যাঞ্চ ও প্রধান কার্যালয় স্কাইওয়াকার র্যাঞ্চ সম্পর্কে ম্যাককালাম বলেছিলেন, এটি এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারত, পার্টি করতে পারত, গল্প লিখতে বা নতুন কিছু ভাবতে পারত। তার ভাষ্যে, ‘এটি ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণ ক্যাম্প।’