দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য-বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত ২০২৪ সালের ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
ফোর্বস জানিয়েছে, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সারিতেই আছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনী তিনি। আগের বছর (২০২৩) সে দেশের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৪২ নম্বরে ছিলেন। ২৪-এ এক ধাপ এগিয়েছেন তিনি
সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল ফোর্বসে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় ৭৮টি দেশের ২ হাজার ৭৮১ জনের নাম প্রকাশ করা হয়।
আর সেই তালিকায় আজিজ খান রয়েছেন ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। জ্বালানি খাত থেকেই তিনি এ বিপুল সম্পদ আয় করেছেন বলে জানানো হয়েছে সেখানে
ফোর্বস বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়া আজিজ খান এখন সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের কর্ণধার ৬৮ বছর বয়সী আজিজ খান। সামিট গ্রুপ বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস, আবাসন ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে কাজ করে। আজিজ খান সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, ভাই আওয়ামী লীগের দলীয় শীর্ষ ফোরাম প্রেসিডিয়ামের মেম্বার ও প্রভাবশালী মন্ত্রী। বলা যায়, ক্ষমতার একদম শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান। বাড়তি পাওনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহ আর আশীর্বাদ। আর এতেই দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী ফারুক খানের ভাই আজিজ খান।
গত ১৫ বছরে এই ক্ষমতার ঢাল ব্যবহার করে তিনি শুধুই তর তর করে ওপরে উঠেছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ, সরকারি কেনাকাটা, পণ্য ও সেবার সরবরাহ করে সবাইকে পেছনে ফেলে ধনী থেকে আরো ধনী হয়েছেন। বেসরকারি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের মালিক মুহাম্মদ আজিজ খানের পরিচিতি এখন শুধু বাংলাদেশের ধনী হিসেবেই নয়; বরং তিনি এখন সিঙ্গাপুরেরও অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তি।
প্রতিবেদনে জানা যায়, দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন দেশে, আর তা পাচার করে ধনকুবের হয়েছেন সিঙ্গাপুরে। বলতে গেলে, বিলিয়নিয়ার আজিজ খান প্রায় পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্য সূত্র ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে সামিট গ্রুপের আজিজ খানের নাম শীর্ষে উঠে আসে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। জানা যায়, ক্ষমতার প্রভাব আর আইনি জটিলতায় এখনো শেষ হয়নি অনুসন্ধান।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) দপ্তর থেকে সম্প্রতি সামিট গ্রুপের দুর্নীতির তথ্য বের হয়েছে। মাত্র দুই মাস আগেই বিটিআরসি থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সামিট কমিউনিকেশনস কোনো ফি ছাড়াই তার শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। তবে আকস্মিকভাবেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সংস্থাটি। অভিযোগ উঠেছে, সামিট কমিউনিকেশন নতুন শেয়ার ইস্যুর আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল।
সামিট কমিউনিকেশন ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর টেলিকম ও ইন্টারনেট সেক্টরের বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মার্চের শেষের দিকে আবুধাবি ও মরিশাস-ভিত্তিক দুটি পৃথক কোম্পানির কাছে ১৭০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যু করার জন্য বিটিআরসির অনুমোদন চায়। আবেদন অনুসারে প্রতিটি শেয়ার ১২ টাকা দরে মোট ১৪.২০ কোটি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। এর এক মাস পর এটির প্রাক-অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরের মাসেই সরকারি অনুমোদন আসে। এরপর চলতি বছরের ১২ জুন বিটিআরসি কোম্পানিটিকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার ট্রান্সফারের অনুমতি দেয়।
সরকারি অনুমোদনের জন্য পাঠানোর আগে বিটিআরসি আইনি মতামত চেয়েছিল। যেখানে সামিট কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে কোনো চার্জ প্রযোজ্য হবে না বলে মতামত দেওয়া হয়েছিল। তবে বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সামিট আসলে নতুন শেয়ার ইস্যু করার আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল। ফলে সামিটের ওপর বিটিআরসির আইনি ও লাইসেন্সিং শর্ত অনুযায়ী চার্জ প্রযোজ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক বিমান ও পর্যটন-মন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে সামিটকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ বিটিআরসির কর্মকর্তাদের।
সামিট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শেয়ার বিক্রির চুক্তিও বিটিআরসিকে জমা দেয়। সেখানে দেখা যায়, আবুধাবি-ভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জিকে সামিটের যে নতুন শেয়ার দেওয়ার চুক্তি হয়েছে, তার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একজন হলেন আদিবা আজিজ খান, যিনি ফরিদের বড় ভাই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন শেয়ারের মধ্যে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ৯.৪৪ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল। অন্যদিকে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের আরো ৪.৪ কোটি শেয়ার মরিশাস-ভিত্তিক সেকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়েছিল।
এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকারের পতন হলে বিটিআরসি আইন সংস্থাকে আবার চিঠি দিয়ে বলে, তাদের আইনি মতামত শুধুমাত্র উপদেশমূলক; বাধ্যতামূলক নয়। এরপর গত ১৫ আগস্ট সামিট কমিউনিকেশনকে তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ফি না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে চিঠি পাঠায় বিটিআরসি।
সামিট কমিউনিকেশনের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামিট কমিউনিকেশনস বিটিআরসির দেওয়া ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিকে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা দিয়েছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সামিট কমিউনিকেশনের এই অর্থ নয়ছয় করার চেষ্টা এবং পরে অর্থ প্রদান করা, সামিট গ্রুপের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ। ফলে এই অর্থ প্রদানকে সামনে রেখে যেন সামিটের ক্ষমতার অপব্যবহারের আড়ালে আর্থিক অনিয়ম ঢাকা না পড়ে।’
এদিকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গত ৭ অক্টোবর সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ আজিজ খান, মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, আঞ্জুমান আজিজ খান, আয়েশা আজিজ খান, আদিবা আজিজ খান, আজিজা আজিজ খান, জাফর উদ্দিন খান, মোহাম্মদ লতিফ খান, মোহাম্মদ ফরিদ খান, সালমান খান ও মোহাম্মদ ফারুক খানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, আজিজ খানের ক্ষমতার ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে পরিচিত সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানকেও গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নানান পটপরিবর্তনে ভাগ্য খুলে যাওয়া ফারুক খান ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোটি টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন কিনে হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা। ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। টানা ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।