বাংলাদেশের বনজ সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারকে অনেক ক্ষেত্রেই বৈধতা দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা আইনের মধ্য দিয়ে। এবার নতুন আইন প্রনয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কী পারবে তার দ্রুত ক্ষয়িঞ্চু বনভূমি সংরক্ষনে সফল হতে?
শ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এই মুহূর্তে দুটি নতুন আইন অনুমোদনের পথে সব ধরনের প্র্র্র্র্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। এই আইন দু’টির প্রধানতম লক্ষ্যই হচ্ছে দেশের বন সম্পদের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের ধারণায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা।
শীঘ্রই অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা এই আইন দুটিকে বন সংরক্ষনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বনকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রন করে দেশের দ্রুত ক্ষয়িঞ্চু প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহনে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে।
ফরেস্ট বিল, ২০২৩ ফরেস্ট অ্যাক্ট, ১৯২৭-কে প্রতিস্থাপন করবে যেটি বৃটিশ শাসনামলে প্রণয়ণ করা হয়। ঔপনিবেসিক আমলের এই আইনে বনকে মূলত সরকারের রাজস্বের উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে বন বিভাগ দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনভূমি রয়েল আবাসভূমি হিসেবে খ্যাত সুন্দরবনে কাঠ আহরনের জন্য নিলাম ব্যবস্থা এবং মাছ, ফল, মধু, আহরণের জন্য পারমিট প্রদান করে রাজস্ব আয় করে আসছে দিনের পর দিন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনভূমি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা দুর্যোগের মুখোমুখি।
প্রস্তাবিত অপর আইনটির (বন সংরক্ষণ বিল ২০২৩) মাধ্যমে বনের বাইরেও গাছ কাটাকে নিষিদ্ধ করা হবে।
পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “এই আইন দু’টি প্রণয়নের পর আমাদের দেশের বনভূমি, সবুজ বৃক্ষ এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণে একটি আমূল পরিবর্তন আসবে। এটি বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।”
তিনি এই দুটি আইনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “প্রস্তাবিত বিলটি বন কর্মকর্তাদের বন সংরক্ষণ এবং বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সরকারের ঘোষনা বাস্তবায়নে আইনগত ক্ষমতা প্রদান করবে। কিন্তু বনভূমির বাইরেও গাছ, বাগান ও সবুজ বৃক্ষরাজি রয়েছে। মানুষ সেখান থেকে অবাধে গাছ কাটতে পারে । তাই এই সম্পদও রক্ষা করা দরকার।”
ক্ষমতাসীন দলের সদস্য এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, “বিশ্বব্যাপী, বনকে এখন আর সরকারের রাজস্বের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় না।”
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা বিবেচনা করে আমাদেরকে অবশ্যই রাজস্ব আয়ের পথ থেকে সংরক্ষণের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আমরা তাই সরকারকে একটি সংরক্ষণমুখী বন আইন বাস্তবায়নে জোর দাবী জানিয়ে আসছি।”
বন সুরক্ষায় কাজ করা অলাভজনক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস বলেন, “প্রস্তাবিত আইনে কিছু ভালো বিধান রয়েছে।”
“এই বিধানগুলি অবশ্যই বন, জীববৈচিত্র্য এবং বনের বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করবে।”
বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত বন আইন দুটিকে “সংরক্ষণ-কেন্দ্রিক” হিসাবে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-এর (আইইউসিএন) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর থেকে বাংলাদেশের বন বিভাগ কীভাবে সরকারের জন্য রাজস্ব জোগাড় করতে কাজ করেছে তা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “প্রতি বছর, সরকার বনের উপর নির্ভরশীল জনগণ যেমন জেলে এবং মধু সংগ্রহকারীদের অনুমতি প্রদান মাধঃমে রাজস্ব আহরনের জন্য বন বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে। [সরকার] বাজেয়অপ্ত করা কাঠ এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসও নিলাম করে থাকে।”
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি অবশ্য বন আইন-১৯২৭-কে একটি মন্দ আইন হিসেবে মন্তব্য করতে রাজী নই। তবে এই আইনে বেশ কিছু বিষয়ে বৈপরীত্য রয়েছে, যেমন বন বিভাগের কর্মকর্তাদের একদিকে সরকারের জন্য রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়, আবার অন্যদিকে বন সংরক্ষণেরও দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। দুটি পরস্পরবিরোধী দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন।”
ধারনার চেয়ে কম রাজস্ব পাওয়ায় সামনের সারির কর্মকর্তারা কীভাবে শীর্ষ বন কর্মকর্তাদের নিন্দার মধ্যে পড়ত সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে রাজস্ব উৎপাদন এবং বন সংরক্ষণ একসাথে চলতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা “অত্যন্ত খুশি” হবো যদি সরকার বর্তমান আইন সংশোধন করে রাজস্ব উৎপাদন থেকে সংরক্ষণের দিকে অধিক মনোনিবেশ করে।“
১৬ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামল থেকেই বাংলাদেশ বনভূমি হারাচ্ছে। সেসময় বনের একটি অংশকে আবাদযোগ্য জমিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য রেলওয়ে স্লিপার তৈরিতে বড় বড় গাছ নির্বিচারে কাটা হয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ জলপথে পন্য পরিবহনের জন্য নৌকা এবং জাহাজ নির্মাণের ফলেও বনভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষয় হয়।
বিশিষ্ট বন গবেষক এবং সাবেক বন কর্মকর্তা লস্কর মুকসুদুর রহমান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বৃটিশ ভারতের একজন নৌপ্রধান প্রথম বন রক্ষার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধনের ফলে একসময় জাহাজ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।”
বিষয়টি মাথায় নিয়ে বৃটিশ সরকার বন বিভাগ গঠনের এক বছর পর ১৮৬৫ সালে প্রথম বন আইন জারি করে। ১৮৭৮ সালে তারা প্রণয়ন করে, যাতে বন থেকে রাজস্ব অর্জনের বিধান রাখা হয়।
প্রায় ৫০ বছর পর, ঔপনিবেশিক সরকার বন আইন, ১৯২৭ প্রণয়ন করে। ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর তারপরই বন বিভাগ বনভূমি ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
যদিও কিছু কিছু সংরক্ষিত বন রক্ষার দায়িত্ব পালন করে বনবিভাগ যেসব বনভূমিতে জনগনের প্রবেশের । কিন্তু তা স্বত্বেও সামগ্রিকভাবে দেশে বনভূমি ধ্বংসের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
২০০২ সালে, গবেষক মোহাম্মদ মিল্লাত-ই-মুস্তফা তার এক গবেষনায় উল্লেখ করেন যে ৮০-এর দশ জুড়ে প্রতি বছর ৮,০০০ হেক্টর বনভূমি হারিয়ে যেতে থাকে। তিনি ইউএসএআইডি-সিআইডিএ-র একটি সমীক্ষার কথা উল্লেখ করেন যাতে বলা হয় বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ বন গত ২০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে।
গত বছর, আরণ্যক ফাউন্ডেশন রেইনখয়ং সংরক্ষিত বনের উপর একটি সমীক্ষা চালায়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০% জুড়ে বিস্তৃত এবং বাংলাদেশের পাঁচটি সংরক্ষিত বনের মধ্যে একটি।
উল্লেখিত গবেষণায় দেখা যায় যে রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতরে প্রায় ৬০% গাছ হারিয়ে গেছে। এতে আরো বলা হয় যে রিজার্ভ ফরেস্ট এবং রিজার্ভের এর বাইরের বনের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত আইনগুলো সঠিক পথে পরিচালনার জন্য একটি উত্তম পদক্ষেপ। নতুন আইনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল যে বন কর্মকর্তারা আর বন থেকে রাজস্ব আয় করার কথা ভাবতে গিয়ে সরকারের চাপে থাকবেন না। এটি কর্মকর্তাদের মানসিকতার উপর একটি উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত আইন স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করবে না, যারা আসলে বন ও পরিবেশের প্রকৃত রক্ষক।
তিনি বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা দেখেছি যে স্থানীয় লোকেরা বন ধ্বংস করে না। কারণ এতে তাদের বেঁচে থাকার জীবন-জীবিকা জড়িত। এদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন থেকে যারা মধু, মাছ, গোলপাতা [নিপা পাম] এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করেন তাদের অবশ্যই টেকসই কোনো জীবিকার সুযোগ দিতে হবে।”
গবেষক রহমান অবশ্য সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, নতুন আইন প্রণয়নের চেয়ে আইনের আন্তরিক ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নতুন আইনটি সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে বন সংরক্ষণের বিষয়টি আবারো বাঁধাগ্রস্ত হবে।”