রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন

দীপু মনির টাকার খনি ছিল মেঘনার বালু

  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কারাগারে গেলে সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ আদালতে যেতেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে যেদিন এই আদালতে নেওয়া হতো সেদিন দীপু মনিকেও আদালত এলাকায় দেখা যেত। মূলত শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তিনি তার সামনে গিয়ে চেহারা দেখাতেন। এভাবে চেহারা দেখানোর কারণে দীপু মনির কপাল খুলে যায়। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তিনি। ওই নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন। হয়ে যান বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর ডা. দীপু মনি হয়ে যান চাঁদপুর জেলার নিয়ন্ত্রক। হাত পাকান নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে। গড়েন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। এমন কি, আখের গোছাতে গিয়ে তিনি চাঁদপুর আওয়ামী লীগকেও কয়েক ভাগে বিভক্ত করেন। এত কিছুর পরও গত প্রায় ১৬ বছরে দীপু মনি সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্রেই থাকতে সক্ষম হয়েছেন।

দীপু মনি টানা চারবার চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনে এমপি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং সর্বশেষ সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি অনেক সিনিয়র নেতাকে ডিঙিয়ে হয়ে যান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ঘনঘন বিদেশ যাত্রার কারণে ওই সময় ‘উড়াল মন্ত্রী’ হিসেবেও পরিচিতি পান। তবে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে ছিলেন বেশি সমালোচিত।

অভিযোগ রয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে দীপু মনি সাড়ে চার বছরে ১৮৭ বার বিদেশ সফর এবং ৬০০ দিন বিদেশে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আনতে ২০০৯ সালে সরকার যে লবিষ্ট নিয়োগ করে, তার দায়িত্ব নিজের স্বামীকে দেন তিনি। আর এ কাজের মাধ্যমে তিনি অনেক টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে লড়তে বাংলাদেশের পক্ষে যে বিলেতি ল’ ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছিল, তাতেও দুর্নীতির আশ্রয় নেন দীপু মনি। ওই ফার্মকে বিপুল অংকের সম্মানী দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

চাঁদপুরের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেছেন, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে দীপু মনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগকে করেছেন কয়েক ভাগে বিভক্ত। এ ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একাংশকে নিয়ে একক রাজত্ব কায়েম করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দলীয় প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই ছিল তার চক্ষুশূল। তিনি তাদের ছাড়াই অগ্রহণযোগ্য নবীন নেতা ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এতে দীর্ঘদিনের দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মী ছাড়াও পুরো চাঁদপুরবাসীর মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এরপরও হামলা-মামলার ভয়ে কেউ কখনো মুখ খুলতে পারেননি দীপু মনির বিরুদ্ধে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর আত্মগোপনে গেলেও গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারান্তরীণ তিনি।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম বলেন, একটি সংগঠন ব্যক্তি কিংবা পরিবারতান্ত্রিক হবেÑ এটা মোটেও কাম্য নয়। ইতোপূর্বে একজনের কারণে জেলা নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনৈক্য ছিল। এটা সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে আমি অতীতেও চাইনি, এখনও চাই না। কারণ, যে কোনো অনৈক্য সংগঠনকে দুর্বল করে দেয়।

এদিকে দীপু মনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ, চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ৬০০ কোটি টাকা লুটপাটেরও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা জালিয়তির পাঁয়তারায় তার ভাই টিপুসহ বাহিনীর সদস্যরা জড়িয়ে পড়ে। এই লুটপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিসের মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠির পর। এ কারণেই ওই সময়ে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েও শহর রক্ষায় স্থায়ী ও শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ভেস্তে যায়।

এ ছাড়া জাপানি অর্থায়নে মেঘনার চরে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে ৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মেঘনায় বন্ধ হয়ে যাবে দীপু মনির শত শত কোটি টাকার অবৈধ বালি বাণিজ্যÑ এই আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করেন তিনি ও তার ভাই জে আর ওয়াদুদ টিপুু।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটির পরিচালক মো. মাইনুল হাসান দোলন বলেন, এই প্রকল্পটির সঙ্গে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। বিনিয়োগকারীরা প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাছাই করে একটি রূপরেখা দীপু মনির কাছে দিয়েছিল। তবে ওই রূপরেখায় প্রকল্প এলাকার ৬-৭ কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজিং কিংবা বালু খনন করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে ওই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।

দীপু মনির ক্ষমতাবলে জে আর ওয়াদুদ টিপু হাইমচর উপজেলার ৪ নম্বর নীলকমল ইউনিয়নের বাহের চরে ৪৮ একর সরকারি খাসজমি দখল করে গড়ে তোলেন ‘টিপু নগর’। সেই জমি তিনি নিজ নামে দখলে নিয়ে তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদিপশুর খামার ও সবজি বাগান। যদিও বিষয়টি জানতে পেরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ সরকারি ভূমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে দীপু মনি ওই জেলা প্রশাসককে নেত্রকোনায় বদলি করে দেন।

২০১৯ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন দীপু মনি। এরপর ২০২১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মশিউর রহমানকে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্য থাকায় তিনি মন্ত্রীর হয়ে নেমে পড়েন তদবির বাণিজ্যে। আর তার এ কাজে সহযোগিতা করতেন পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। এসব বাণিজ্যের ঘুষের টাকা লেনদেনের রফাদফা করতেন দীপু মনির ভাই টিপু। তিনিই বোনের ক্ষমতাবলে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে ভিসি পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসনের সব পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষ নিয়োগে ৫০ লাখ ও ভিসি নিয়োগে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতেন টিপু। একাধিক শিক্ষক বলেন, টিপুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করত সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি।

চাঁদপুর শহরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, টিপু ও রতন মজুমদারের মনমতো না হলেই ওই শিক্ষক হয়ে যেত বিএনপি-জামায়াত। যেমন আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিকুলাম বিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় আমাকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল।

অভিযোগ রয়েছে, দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরেরও নিয়ন্ত্রণ নেন টিপু। তিনি এ দপ্তরের ঠিকাদারদের কমিশন ছাড়া কাজ দিতেন না।

এ ছাড়াও দীপু মনি গত প্রায় ১৬ বছরে রাজনৈতিক মোড়কে চাঁদপুরে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। এতে আওয়ামী লীগের ত্যাগীরা বঞ্চিত হয়। জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে তার নির্দেশনায় স্থান পায় নানা অপরাধে জড়িত ও অগ্রণযোগ্য ব্যক্তিরাও। আর ওইসব ব্যক্তিরাই সবসময় তাকে ঘিরে থাকত। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্ধারণও ছিল তার একটি বড় বাণিজ্য। আর তার এসব অপকর্মের মূলহোতা ছিলেন ভাই ডা. জে. আর ওয়াদুদ টিপু। বোনের হয়ে তিনিই সব লেনদেন করতেন।

সাবেক এই মন্ত্রীর সবচাইতে বড় টাকার মেশিন ছিল লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিম খান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার হাত ধরেই উত্থান হয় সেলিম খানের। তিনি মেঘনা হতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতেন। আর তার ভাগ পেতেন দীপু মনি। তাই তাকে বারবার ডিও লেটার দিয়ে নির্বিচারে পদ্মা-মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সুযোগ করে দেন দীপু মনি। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণপিটুনিতে নিহত হয় সেলিম খান।

অভিযোগ রয়েছে, সেলিম খানের এই বালুমহাল থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন দীপু মনি ও তার ভাই টিপু। যদিও এই অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সেলিম চেয়ারম্যানকে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা দিতে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক। অথচ এই অবৈধ বালু উত্তোলনের সমালোচনা করায় ২০২৩ সালে ২৬ সেপ্টেম্ব^র নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীও পদ হারান।

এ প্রসঙ্গে ড. মনজুর আহমেদ বলেন, মেঘনায় অবৈধভাবে যারা বালু তুলছে, তাদের সঙ্গে একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে বলে আমি মন্তব্য করেছিলাম। আর ওই ঘটনার পরই আমি আমার পদ হারাই।

এদিকে দীপু মনির প্রায় দেড় যুগের সাম্রাজ্যে ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলকে দমন, নিপীড়ন, হামলা ও মামলা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী পেটুয়া বাহিনীর দ্বারা জেলা বিএনপির অফিস এবং সভাপতির বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে, যা চাঁদপুরের ইতিহাসে ছিল বিরল। অথচ একক রাজত্ব করা দীপু মনি হত্যা ও ভাঙচুরের মামলায় এখন কারাবন্দি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com