ক্রাংছড়ি লাইটলুম

যারা ভ্রমনে গিয়ে শুধু শিলং শহর বা চেরাপুঞ্জি দেখে ফিরে আসেন তারা কিন্তু অনেক কিছু মিস করে ফেলেন। শিলং থেকে ৬৭ কিলোমিটার দুরে রয়েছে ক্রাংছড়ি গ্রাম। এর যাত্রা পথে চোখে পড়বে একপাশে পাথুরে পাহাড় আর অন্যপাশে গাঢ় সবুজ বন, যা নিশ্চিত চোখের প্রশান্তি এনে দেবে। বাঁক পেরিয়ে হঠাৎ যে ঝর্ণা দেখা দেবে সেখানে পা না ভিজিয়ে যেতেই পারবেন না। ঝকঝকে পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় হঠাৎই বুনো ফুলের উপত্যাকা আপনাকে জানাবে সাদর সম্ভাষন। বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখতে পাবেন ধানচাষ। পাহাড়ের ঢালে সোনারঙের বুনো ঝোপঝাড় তৈরী করবে এক অন্যরকম মাদকতা।

শিলং শহর থেকে ক্রাংছড়ির যেতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই থেকে তিনঘন্টা। পাহাড়ি রাস্তায় প্রচুর বাঁক থাকায় গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটতে পারেনা। যারা ক্রাংছড়ি ঘুরতে যাবেন, তারা একটু হিসেব করে চললে খরচ অনেক কমিয়ে আনতে পারবেন। ক্রাংছড়িতে যাবার গাড়ি ভাড়া পড়বে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার রুপি। কিন্তু আমরা ৫ দিন একই গাড়ি রাখায় আমাদের খরচ হয়েছে মাত্র লাইটলুমসহ ৩,৫০০ রুপি। যদিও ড্রাইভার বলেছিল দুটি স্পট দেখার জন্য অন্যদের গুনতে হবে ৫০০০ রুপি।

তিন ঘন্টার দারুণ জার্নি শেষে অবশেষে গিয়ে পৌছালাম ক্রংছড়িতে। গাড়ি যেখানে থামলো সেটা এক গ্রাম্য হোটেলের মত। প্রথম ধাক্কায় মনে হলো রাস্তাটাই সুন্দর, কিন্তু টিকিট কেটে যখন সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম সেখানকার অপরুপ সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চারপাশে ঘন সবুজ বন মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণা। ঝর্নার উল্টো পাশেই স্বচ্ছ পানির লেক। যে কেউ বোটে চড়ে ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবে অনায়াসে।

আর ঝর্ণার পানি পড়ে যে জলাধার তৈরী হয়েছে সেখানে গোসল করতে হলে লাইফ জ্যাকেট পড়া বাধ্যতামূলক। লেক, পাহাড় আর ঝর্ণার সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকতে চাইলে এখানকার ভাড়া করা তাবুতে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারেন দুটো দিন। সব ঘুরে যখন ফেরার পথে পাহাড়ি হোটেলে বুনো মোরগের মাংস আর নানা রকম সব্জি দিয়ে খেতে বসবেন তখন মনে হবে অমৃত।

পরের গন্তব্য লাইটলুম। লাইটলুম অর্থ হলো আলোর শেষ। লাইটলুম হচ্ছে শিলং এর সবচেয়ে উঁচু স্থান, একে জিরো পয়েন্টও বলা হয়। যারা ঘুরতে যাবেন তাদেরকে জানিয়ে রাখি, অবশ্যই দুপুর ১ টার মধ্যে যাবেন। তা নাহলে এখানকার সৌন্দর্য মেঘে ঢেকে থাকবে। ক্রাংছড়ি থেকে লাইটলুম যেতে সময় লাগবে দেড়ঘন্টা। সবার জন্য একটা দারুণ তথ্য দিয়ে রাখি লাইটলুমে কিন্তু রকঅন ২ সিনেমার সুটিং হয়েছিলো।

লাইটলুমের পুরো রাস্তার দুপাশে দেখা মেলে সোনালী ক্ষেত, মাঝে মাঝে সাদা ছোট জংলি ফুলের কার্পেট, সবুজ ধান ক্ষেত, নানা রঙের বুনো ফুল আর ভয়ঙ্কর সুন্দর ঝর্ণা। এর যাত্রাপথ এতটাই পরিচ্ছন্ন আর শান্ত যে, অনায়াসে ভাবতে পারেন এটা এশিয়ার সুইজারল্যান্ড। লাইটলুমের কাছাকাছি পৌঁছতে অনেকটা উঁচু পাহাড়ি পথ পার হতে হয়। হঠাৎ করে গাড়ি উঁচুতে ওঠায় সবার কানে বাতাসের ঝাপটা লাগছিল। লাইটলুমে যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল চারটা। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে পেজা তুলোর মেঘ মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল। একেবারে কাছের জনকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

ড্রাইভার জানালো- ইধারছে বাধল ঘুমতা রাহে। অর্থাৎ এখানে সারাদিনই মেঘ ভেসে বেড়ায়। কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছেনা। প্রচন্ড ঠান্ডায় একেবারে জমে গেছি। কাঁপতে কাঁপতে রওয়ানা ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। ভিউ পয়েন্টের একেবারে নিচ পর্যন্ত যেতে ভাঙতে হবে প্রায় শ’খানেক সিঁড়ি। অনেক কষ্ট করে যখন সিঁডি বেয়ে নামবেন তখন চারপাশের সবুজ প্রকৃতি, মাথার ওপর ঘুরতে থাকা মেঘ আপনাকে পৌঁছে দেবে এক স্বপ্নের জগতে। শূন্যতার মাঝে মেঘের ভেলায় ভেসে  নিজেকে উপলব্ধি করার এমন সুযোগ মেলা সত্যিই ভার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: