শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ অপরাহ্ন

এত কোরবানির মাংস কী করে সৌদি

  • আপডেট সময় শনিবার, ১ জুলাই, ২০২৩

ঈদুল আজহা মুসলিমদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। উৎসবটা মূলত উৎসর্গের ও ত্যাগের। কারণ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ঈদুল আজহায় বিশ্বব্যাপী একযোগে মুসলিমরা পশু কোরবানি করে। হজের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে সৌদি আরবে প্রতিবছর লাখ লাখ পশু কোরবানি করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এত মাংস দেশটি কী করে?

আরবি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আজহা উদ্‌যাপন করা হয়। এই ঈদের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ পশু কোরবানি। মুসলিমদের মধ্যে যারা হজ করতে সৌদি আরবে যান, তারা হজ শেষে পশু কোরবানি করেন। এটাকে মূলত ‘হাদি’ বলা হয়ে থাকে।

হাজিরা সাধারণত ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকে (আইডিবি) পশুর নির্ধারিত মূল্য জমা দিয়ে তাদের মাধ্যমেই কোরবানি দেন। এছাড়া হাজিদের একটি অংশ নিজেরাই পশু কোরবানি করে থাকেন। তবে পশু জবাইয়ের নির্ধারিত স্থান ছাড়া যেখানে সেখানে কোরবানি দেয়া নিষিদ্ধ দেশটিতে।

মক্কায় যেভাবে ঈদুল আজহা ও পশু কোরবানি হয়

সৌদি আরবে সূর্যোদয়ের পরপরই মক্কার কাবা শরিফে ঈদের নামাজ হয়। হাজিরা তখন মুজদালিফায় থাকায় তাদের ঈদের নামাজ পড়তে হয় না। ফজরের নামাজ পড়ে সূর্যোদয়ের কিছু আগে তারা মিনার উদ্দেশে রওনা হন। 
 
এরপর তাঁবুতে পৌঁছে বিশ্রাম ও নাস্তা সেরে বড় জামারায় গিয়ে শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করেন। জামারা হলো মিনা ময়দানে অবস্থিত তিনটি স্তম্ভ। এগুলোর নাম জামারাতুল উলা বা ছোট জামারাহ, জামারাতুল উসতা বা মধ্যম জামারাহ ও জামারাতুল কুবরা বা বড় জামারাহ। পাথর নিক্ষেপের পরবর্তী কাজ হলো কোরবানি করা।

হাজিদের একটি অংশ নিজে মুস্তাহালাকায় (পশুরহাট ও জবাই করার স্থান) গিয়ে কোরবানি দেন। আরেকটি অংশ ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকে (আইডিবি) ৪৫০রিয়াল জমা দিয়ে তাদের মাধ্যমে কোরবানি দেন। এতে সময় বাচে এবং নিরাপদ, প্রতারিত হওয়ারও সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজিদের একটি অংশ প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষ করে নিজ জেলার কোনো প্রবাসীকে পেলে তাদের মাধ্যমে কোরবানি দেন। এই প্রবাসীরা মূলত হজ উপলক্ষে পশু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। অন্য কাউকে দিয়ে কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতারণার ঘটনাও ঘটে। হজে কোরবানির পশুর মধ্যে ছাগল, দুম্বা ও উটই প্রধান।

পশু জবাই ও মাংস বিতরণ

ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক তথা আইডিবির তত্ত্বাবধানে সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয় মক্কায়। আইডিবির মাধ্যমে কোরবানির জন্য কুপন মুল্য ৪৫০ রিয়াল। এর মধ্যে পশুর দাম, কসাইখানার খরচ, হিমাগারে মাংস সংরক্ষণ ও পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশের গরিব লোকজনের মধ্যে এই মাংস বিতরণের খরচ বাবদ এ মূল্য নেয়া হয়।
 
প্রতি বছর ‘দুম্বার মাংস’ নামে বাংলাদেশেও এ মাংস পাঠানো হয় এবং সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিলিবণ্টন করা হয়। এছাড়া আফ্রিকা ও এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে এসব মাংস বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশি দেয়া হয়।

আইডিবির এ প্রজেক্টটির নাম ‘ইউটিলাইজেশন ফর দ্য সেক্রিফিশিয়াল অ্যানিমেল’ যা আদাহি নামেও পরিচিত। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইএসডিবি) সভাপতি ডক্টর বান্দার হাজ্জারের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, হজে বিভিন্ন দেশে মাংসের বিতরণের প্রকল্পটি ৩৭ বছর আগে চালু হয়েছিল। সৌদি সরকার এটি পরিচালনা করে আসছে।
 

যেভাবে শুরু হয় আদাহি প্রকল্প

বছরের পর বছর ধরে হজের সময় মাংসের প্রাচুর্য সৌদি আরবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। হাজিরা কোরবানির সব মাংস খেতে পারে না। ফলে তারা সেগুলো রাস্তায় ফেলে দিত। দিন দিন হাজির সংখ্যার সঙ্গে বাড়ছিল পশু কোরবানি সংখ্যাও। এর ফলে অনেক মাংস অপচয় হতো। এছাড়া রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া মাংস পচে দুর্গন্ধ ছাড়াত, দূষণ হতো পরিবেশ।

অপচয় ও দূষণ এড়াতে দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য সৌদি সরকার ১৯৮৩ সালে প্রথম এ উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটি পরিচালনা করার জন্য সরকার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (আইডিবি) দায়িত্ব দেয়।

২০০০ সালের পর আদাহি প্রকল্পটি আরও বিকশিত হয়। যেখানে বর্তমানে ৪০ হাজারেরও বেশি কর্মচারী কাজ করে। অতিরিক্ত মাংস নিরাময়ের জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেন্দ্রটিতে প্রতিদিন ৫০০ টন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করা যায়। এবং কারখানায় ব্যবহার করা যেতে পারে এমন নিষ্কাশিত চর্বি থেকে আলাদা করে প্রাকৃতিক সার তৈরি করা হয়।

প্রকল্পটি শুরুর প্রথম বছরে ৬৩ হাজার গবাদি পশু জবাই করা হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে তা কয়েকজন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর (২০২২) প্রায় ১০ লাখ কোরবানি হয়েছে। আর এ বছর আনুমানিক ২০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
 
এসব কোরবানির মাংস নিয়ম মেনে বণ্টন করা হয়। মসজিদুল হারামের আশেপাশের দরিদ্রদের মধ্যে গোশ্‌ত বিতরণ শুরু হয় পবিত্র ঈদুল আজহার প্রথম দিন এবং মুসলিম দেশগুলিতে শিপিং শুরু হয় মহররম মাসের প্রথম দিন।

এছাড়াও সৌদি আরবের মধ্যে ২৫০টি দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে মাংস বিতরণ করা হয়। যা শ্রম ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় দ্বারা স্বীকৃত ও যাদের কাছে মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর ও যোগ্য সুবিধাভোগীদের কাছে এটি পরিবহনের জন্য ফ্রিজার রয়েছে।

যেভাবে পরিচালিত হয় প্রকল্পটি

প্রকল্পটি দশটি সরকারি সংস্থা দ্বারা তত্ত্বাবধান করা হয়। সেগুলো হলো- অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিচার মন্ত্রণালয়, পৌর ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, পানি ও কৃষি মন্ত্রণালয়, শ্রম ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, মক্কা আল-মুকাররামা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং হজ ও ওমরাহ পরিচালনার জন্য দুই পবিত্র মসজিদ ইনস্টিটিউটের কাস্টোডিয়ান।

এ প্রকল্পে সৌদি সরকার প্রতিনিয়ত সাহায্য করে যাচ্ছে। প্রজেক্ট পরিচালনার সুবিধার্থে ও দরিদ্রদের খাদ্য সরবরাহে প্রকল্পের ভূমিকা প্রসারিত করার জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় সজ্জিত নতুন কসাইখানা স্থাপনের জন্য ২০০ কোটি রিয়াল বরাদ্দ করেছে।

গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) অনুসারে, যুদ্ধ, সশস্ত্র সংঘাত, খরা, জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারির বিস্তারের ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও পূর্ব এশিয়ায়।

এছাড়া ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তাই প্রকল্পটি বেশ কয়েকটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি যদি চায় মৃত্যুর পর তার সম্পদ এ প্রকল্পে দিয়ে যাবে তাহলে তিনি তা মৃত্যুর আগে প্রকল্পের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন।
 
২০১৯ সালে দেশটি মক্কার হারাম এলাকায় একটি প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ পশু কোরবানি দেয় এবং সেসব মাংস ৮৪ ঘণ্টার মধ্যে দরিদ্রদের বিতরণ ও বিশ্বের ২৭টি দেশে পাঠানো হয়।

প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৩০ লাখ পশু কোরবানি দেয়া হয়েছে। যার পুরো মাংস মুসলিম দেশগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষের ঘরে এ মাংস পৌঁছানো হয়েছে।

সম্প্রতি আফ্রিকার ৭টি দেশে ২৪ হাজার কোরবানির পশু পাঠিয়েছে সৌদি আরব। এর মধ্যে আজারবাইজান, মালি, মোজাম্বিক, চাদ ও গাম্বিয়াতে ৩ হাজার করে, নাইজারে ৪ হাজার ও জিবুতিতে ৫ হাজার কোরবানির পশু পাঠানো হয়েছে। বিতরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী সরকার গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন মানবিক সমিতি ও সংস্থা জড়িত থাকে। 

এ বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য ২৫ হাজার কোরবানির পশুর মাংস পাঠাবে সৌদি আরব। কোরবানি ও হজের সময় জবাই করা পশু থেকে ফিলিস্তিনিদের এ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।।

সৌদি সংবাদ সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ১৩ ট্রাক সমপরিমাণ এসব মাংস রমজান মাসেই গাজায় পাঠানো হবে। গাজার কয়েক হাজার দরিদ্র পরিবারের মধ্যে এই মাংস বণ্টন করা হবে। প্রতিটি পরিবারের জন্য ১০ কিলোগ্রামের একটি বিশেষ প্যাকেট বরাদ্দ করা হয়েছে। গাজার ধর্ম মন্ত্রণালয়কে এ মাংস বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম আল ওয়াতান জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সৌদি সরকার মাংস পাঠানোর যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং গাজা পর্যন্ত পৌঁছাতে মাংসগুলো যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com