আজারবাইজানের সরকারী নাম “রিপাবলিক অফ আজারবাইজান”। এটি কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত দেশ। দেশটির পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তরে রাশিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া, পশ্চিমে আর্মেনিয়া এবং দক্ষিণে ইরান অবস্থিত। উত্তর-পশ্চিমে তুরস্কের সঙ্গেও এর সংক্ষিপ্ত সীমান্ত রয়েছে। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম।
আজারবাইজান তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। অবকাঠামো এবং সামরিক খাত উন্নয়ন- সব ক্ষেত্রেই এই তেলের অর্থই ব্যবহার করে দেশটি। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশটি অন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। তবে একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য, যা দেশটির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। পর্যটন খাতেও দিন দিন উন্নতি করছে দেশটি। দেশটির মাটিতে জ্বলা আগুন দেখতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন।
তাহলে বন্ধুরা চলুন, আজারবাইজান দেশ সম্পর্কে আরো কিছু জানা-অজানা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১। ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যকার স্থলবাণিজ্যপথের উপর এবং কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত বলে বহু শতাব্দী ধরে রাশিয়া, পারস্য এবং উসমানীয় শাসকেরা আজারবাইজান দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। অবশেষে ১৮২৮ সালে তুর্কমেনচায় চুক্তির মাধ্যমে রুশরা আজারবাইজান অঞ্চলটি পারস্যের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। ঐ সময়ে নির্ধারিত সীমান্তই আজারবাইজান ও ইরানের বর্তমান সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। এরপর ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ১৯১৮ সালে আজারবাইজান নিজেকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে রুশ সেনাবাহিনী এই স্বাধীনতার অবসান ঘটায়। ১৯২২ সালে প্রথমে দেশটি আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিণত হয় এবং পরে ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালের ৩০শে আগস্ট আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
২। ৮৬ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১১২ তম দেশ।
৩। দেশটির সরকারী ভাষা আজারবাইজানি, যা তুর্কি ভাষার একটি রুপ। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে আজারবাইজানীয় ভাষায় কথা বলেন। এখানে আর্মেনিয়ান এবং রুশ ভাষাও প্রচলিত আছে।
৪। আজারবাইজানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। দেশটির প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ মুসলিম, যার মধ্যে ৮৫ শতাংশ শিয়া এবং ১৫ শতাংশ সুন্নি মুসলিম। বাকিদের মধ্যে ১ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী।
৫। বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। শহরটি আজারবাইজানের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। শহরটির কাছেই কাস্পিয়ান সাগরে অনেকগুলি তেলক্ষেত্র রয়েছে। তেল পরিশোধন তাই শহরটির প্রধান শিল্প। এটি দেশটির প্রধান শিল্প, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তেল শিল্পের প্রসারের সাথে সাথে শহরটির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন এলাকাটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এর নাম ইচেরি শেহ্র অর্থাৎ ভেতরের শহর। ২০০০ সালে ইউনেস্কো ইচেরি শেহ্রকে একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে মর্যাদা দেয়। এলাকাটির প্রতিরক্ষা প্রাচীরগুলি ১২শ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এখানকার সরু ঘোরানো রাস্তাগুলি দিয়ে অনেকগুলি ঐতিহাসিক স্থানে যাওয়া যায়। আধুনিক বাকু শহরের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে আছে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাকু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, একটি অপেরা ভবন এবং অনেকগুলি নাট্যমঞ্চ ও জাদুঘর। ১৯৬৭ সালে শহরে একটি পাতাল রেল ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাকুর মহানগরে বহু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। শহরটিতে প্রায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস।
৬। দেশটির রাজনীতির ভিত্তি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান।
৭। দেশটির জলবায়ু অত্যন্ত বিচিত্র। গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ১৪-১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৪৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো -৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
৮। দেশটির বিভিন্ন এলাকার মাটিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলে। প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে আগুন জ্বলছে এই অঞ্চলে। বৃষ্টি, বাতাস, বরফেও এই আগুন নেভেনি কখনো। এই আগুন জ্বলার কারন দেশটির ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাসের আধার।
কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে আগুনের ঘটনা বেশ কমে এসেছে। এখনো টিকে থাকা এই ধরনের আগুনগুলোর একটি হলো ‘ইয়ানার ড্যাগ’। চিত্তাকর্ষক এই অগ্নিকুণ্ডটি তাই অনেক পর্যটককেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। স্থানীয় এমনকি বহু বিদেশি পর্যটক আসে এটি দেখতে।
৯। আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র ইরানের পরে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিয়া জনসংখ্যার দেশ। তবে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে আজারবাইজান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
১০। দেশটিতে গণমাধ্যমের কোন স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা দেশের অগ্রগতিকে অনেকাংশেই ম্লান করে দিয়েছে।
১১। দেশটিতে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৯৫ শতাংশ লোক জাতিগতভাবে আজারবাইজানি। অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির লোকের মধ্যে লেজগীয়, রুশ, আর্মেনীয় ও তালিশ জাতির লোক প্রধান।
১২। আজারবাইজানের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। প্রাচীন সংস্কৃতির মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কার্পেট বোনা। এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে কার্পেট বোনার এই ধারা চলে আসছে। পুরুষেরা ভেড়ার শরীর থেকে তুলা ছাড়ায় আর নারীরা সেই তুলাকে শুকিয়ে, সুতা বুনে কার্পেট সেলাই করে।
১৩। দেশটিতে শিক্ষার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা বাধ্যতামূলক। দেশটির বেশিরভাগ মানুষই উচ্চশিক্ষিত।
বাকু স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, আজারবাইজানের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়, এটি ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৪। ফ্রিস্টাইল কুস্তি ঐতিহ্যগতভাবে আজারবাইজানের জাতীয় খেলা হিসাবে বিবেচিত হয়, যেখানে আজারবাইজান আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে যোগদানের পর থেকে চারটি স্বর্ণসহ চৌদ্দটি পদক জিতেছে। বর্তমানে দেশটিতে সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলাগুলির মধ্যে রয়েছে ফুটবল এবং কুস্তি।
১৫। আজারবাইজানের অর্থনীতি বর্তমানে একটি সন্ধি পর্যায়ে বিদ্যমান, যেখানে সরকার এখনও একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেশটিতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ তেলের ভাণ্ডার। বৈচিত্র্যময় জলবায়ু অঞ্চলের কারণে দেশটির কৃষি খাতের উন্নতির সম্ভাবনাও প্রচুর।
১৬। আজারবাইজানের সরকারী মুদ্রা মানাত। ১ মানাত সমান প্রায় বাংলাদেশী ৫০ টাকা এবং ৪২.৩২ ভারতীয় রুপী।
১৭। দেশটির মোট জিডিপি প্রায় $৪৫.২৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু আয় প্রায় $৪,৪৯৮ মার্কিন ডলার।
১৮। আজারবাইজানের ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৯৯৪।