আমরা সাধারণত বয়স বাড়লে ভাবি, একটু শান্তিতে থাকি, কম কষ্ট করি। কেউ কেউ অবসর নেন, কেউ ছেলেমেয়ের সংসারে সময় দেন, কেউ আবার অবসরপ্রাপ্তদের আবাসনে গিয়ে দিন গোনেন। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার শ্যারন লেন সে রকম নন। বয়স ৭৭ হলেও স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি তাঁর। এ বয়সে তিনি এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাকি জীবনটা কাটাবেন সাগরে ভেসে, এক জাহাজে থাকবেন টানা ১৫ বছর!
এটা কোনো কল্পকাহিনি নয়। শ্যারন লেন এখন বসবাস করছেন ভিলা ভি অডিসি নামের একটি রেসিডেনসিয়াল ক্রুজ শিপে। যেটা প্রতি বছর পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে, থামবে নতুন নতুন দেশে, নতুন বন্দরে।
সব ফেলে জাহাজেই বাড়ি বানালেন
শ্যারন লেন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। কাটাচ্ছিলেন সাধারণ জীবন। কিন্তু সেই জীবন তাঁকে শান্তি দেয়নি। বরং তাঁর মনে হয়েছে, তিনি দিন দিন হয়ে পড়ছেন একঘেয়ে, ঘরবন্দী, নিষ্প্রাণ। এরপর তিনি জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ি ছেড়ে দেন এবং নিজের ব্যবহারের সব জিনিসপত্র বিক্রি করে দেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, এক আন্তর্জাতিক ক্রুজে উঠবেন। বুকিংও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান জাহাজই জোগাড় করতে পারেনি। ফলে ভেঙে পড়ে শ্যারনের পুরো পরিকল্পনা। তত দিনে তিনি তাঁর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর ২০২৪ সালের শেষ দিকে খবর পান, ভিলা ভি অডিসি নামের একটি জাহাজ অবশেষে যাত্রা শুরু করেছে। সেদিনই তিনি ফোন করে কেবিন বুক করেন, টাকা পাঠান। আর অপেক্ষা করতে থাকেন নিজের স্বপ্নের জীবনের।
যেমন চলছে তাঁর জীবন
ভিলা ভি অডিসি নামের জাহাজটির কেবিন বিক্রি হয় দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের জন্য। একেবারে নিজের মতো করে থাকার ব্যবস্থা। শ্যারন কিনেছেন একটি ইন্টেরিয়র কেবিন, দাম পড়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে খরচ হয় ৩ হাজার ডলার, মানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এই মাসিক খরচে শ্যারন যা যা পান,
শ্যারন লেন বলেন, ‘আমি আর বাজার করতে যাই না। রান্না করি না। জামা কাপড় ধোয়ার চিন্তাও নেই। আমার মনে হয়, এটা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার চেয়ে অনেক সস্তা।’
দিন কাটে জাহাজের ডেকে
তাঁর কেবিনে জানালা নেই। কিন্তু তাতে একটুও বিরক্ত নন শ্যারন। বলেন, ‘ঘুমানোর জন্য ঘর, বাকি সময় কাটাই ডেকে। আমি হাওয়া খাই, বই পড়ি, মানুষের সঙ্গে গল্প করি। ভালো থাকি।’ তাঁর কেবিনটা জাহাজের সামনের দিকে। কারণ ঢেউয়ের দোলা বেশি পাওয়া যায় সেখানে। আর সেটিই উপভোগ করেন ৭৭ বছর বয়সী এই নারী।
জাহাজটা কেমন
ভিলা ভি অডিসি একসময় প্রায় ৯০০ যাত্রী বহন করতে পারত। কিন্তু এখন এই সংখ্যাটি ৫০০ জনে নেমে এসেছে। জাহাজটিতে রয়েছে ৪৫০টি কেবিন। তাতে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ মানুষ একা থাকেন, যাদের অনেকেই লেনের মতো অবসরপ্রাপ্ত। কেউ কেউ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, লেখক। এমনকি একজন নোবেলজয়ীও আছেন সে জাহাজে বলে জানা গেছে। লেন বলেন, ‘এখানে সবাই সারা জীবন ঘুরেছেন। ভ্রমণটাই যাঁদের নেশা, এমন মানুষদের সঙ্গে থাকলে জীবন সহজ হয়ে যায়।’
ঘুরে বেড়ানো আর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া
প্রতিটি গন্তব্যে জাহাজ এক বা দুই দিন থামে। কেউ কেউ উপকূলে ঘুরতে যান, কেউ আবার জাহাজেই থাকেন। আর জাহাজে থাকে গান-বাজনা, স্থানীয় শিল্পীদের পারফরম্যান্স, এমনকি যাত্রীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সেশন। জাহাজটিতে কর্মরত ব্যক্তি মিকায়েল পিটারসন বলেন, ‘আমাদের একটা স্পিকারস কর্নার আছে, যেখানে যাত্রীরা নিজের জীবনের গল্প বলেন। কেউ বলছেন মহাকাশ ভ্রমণের কথা, কেউ চিকিৎসা বিজ্ঞানের, কেউ রাজনীতির।’
৭৭ বছর বয়সেও শ্যারন লেন থেমে যাননি। জীবন শুরু করেছেন নতুনভাবে। ঘর নয়, শহর নয়, তিনি এখন বাড়ি বানিয়েছেন সমুদ্রে ভেসে থাকা জাহাজে।
সূত্র: সিএনএন ট্রাভেল