হাজার কোটি টাকার মালিক শাহরিয়ার
শাহরিয়ার আলম রাজশাহী শহরের বাসিন্দা হলেও ঢাকার তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০০৫ সালের দিকে রাজনীতিতে আসেন। চেষ্টা করেও বিএনপিতে ভিড়তে না পেরে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন শাহরিয়ার আলম। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ (টাকা, সোনা, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) ছিল দুই কোটি ৩২ লাখ টাকার। বার্ষিক আয় ছিল ৯৮ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় শাহরিয়ার আলমের বার্ষিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় সাত কোটি ৯৩ লাখ টাকা। টানা তিন মেয়াদে এমপি থাকা শাহরিয়ার আলমের সম্পদ বেড়ে যায় প্রায় ৩০ গুণ। স্ত্রী ও সন্তানদের নামে আছে সাড়ে সাত কোটি টাকার সম্পদ।
প্রতিমন্ত্রীর দুই ছেলেরও বার্ষিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৪ টাকা। দুই ছেলের অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে সাত কোটি ৪৫ লাখ টাকার।
এসবের বাইরে তিনি অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে তাঁর একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। তবে পলাতক থাকায় শাহরিয়ারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাঘা উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু অভিযোগ করেন, ‘শাহরিয়ার নিজে সম্পদ গড়েছেন আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামেই একের পর মামলা করিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সিরাজও শতকোটি টাকার মালিক। আর শাহরিয়ার তো হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।’
ফারুক চৌধুরীর মালয়েশিয়ায় বাড়ি-ব্যবসা
রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীও সপরিবারে পলাতক রয়েছেন। ফ্রিডম পার্টির একসময়ের এই সদস্য বিএনপি হয়ে ২০০৫ সালে ভেড়েন আওয়ামী লীগে। তিনি গত প্রায় ১৬ বছরে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য ও প্রকল্প বাণিজ্য করে।
একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, মালয়েশিয়ায় ফারুক চৌধুরীর বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ছবিও দিয়েছেন ফেসবুকে। অথচ ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় ফারুক চৌধুরী হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তাঁর ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না। চলতি বছর নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় তিনি ব্যাংকে জমা দেখিয়েছেন ৯ কোটি টাকা।
গোদাগাড়ীর আবু জাফর নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী অভিযোগ করেন, ‘ফারুক চৌধুরী এলাকায় নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম থেকে শত শত কোটি টাকা আয় করেছেন। শুনেছি, তিনি মালয়েশিয়ায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন।’
শতকোটি টাকার সম্পদ ফজলে হোসেন বাদশার
ফজলে হোসেন বাদশা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে এই দলের সঙ্গে যুক্ত তিনি। কিন্তু গত চারবার সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, গত তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি সরকারি প্রকল্প আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম থেকে অন্তত শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজশাহীর কোর্ট এলাকায় তাঁর একসময়ের ছোট বাড়িটি এখন ৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৯ তলা বাড়ি।
রাজশাহীর হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বাদশা গত ৫ আগস্টের পর কয়েক দিন পলাতক ছিলেন। এখন দেখছি এলাকায় ঘুরছেন। মাঝেমধ্যে একে-ওকে বলছেন, তিনি নাকি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে রফাদফা করছেন। তাই তাঁর নামে কোনো মামলা হয়নি, হবেও না।’
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফজলে হোসেন বাদশা রিসিভ করেননি।
পলাতক আসাদ-আয়েন
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সদ্য সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান আসাদ এবং তার আগের দুইবারের এমপি আয়েন উদ্দিন পলাতক। আসাদের এই কয়েক দিনের সম্পদের তেমন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর পাঁচ ভাই এই কয় মাসেই নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, হাট-ঘাট দখলের বদৌলতে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সর্বশেষ পবার খড়খড়ি হাট লিজ দেওয়ার নামে এক দিনে ৩৫ লাখ টাকা হতিয়ে নিয়েছেন তাঁর এক ভাই—এমনটি দাবি করেন পবা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এমদাদুল হক।
সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন গত ১০ বছরে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর পূর্বাচলে তাঁর তিন কাঠা জমি, স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট, রাজশাহী নগরীর উপশহরে রয়েছে আরো একটি ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে আয়েনের।
সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় ছিলেন বাগমারার দুই সাবেক এমপি
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের আমলে দুই এমপি ছিলেন এনামুল হক ও আবুল কালাম আজাদ। তাঁরা দুজন গত ১৬ বছর ধরেই পরস্পরের বিরোধী ছিলেন। আবার দুজন সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায়ও নামেন। তাঁদের সম্পদ নিয়ে সদ্য কালের কণ্ঠে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
হলফনামা ও স্থানীয়ভাবে এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে এই দুই এমপিরই আড়াই হাজার কোটির সম্পদের তথ্য উঠে আসে। ২০১৪ সালেই দুদকের প্রাথমিক তদন্তে সাবেক এমপি এনামুলের হাজার কোটি টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ তোলা হয়। এর বাইরে তিনি গত ১০ বছরে আরো অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। মালয়েশিয়ায়ও তাঁর সম্পদ রয়েছে।
আরেক এমপি আবুল কালাম আজাদের নিজ নামে ও স্ত্রীর নামেও রয়েছে বিপুল অর্থ। গত ৫ আগস্টের পর তাঁর মাছের খামারের কয়েকটি পুকুরে মাছ লুট হয়েছে। এই সাবেক এমপিরও অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে। তিনি গত সাত মাসে পুকুর কেটেই অন্তত ৩০০ কোটি টাকা আয় করেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
বাগমারার বাসিন্দা আনছার আলী বলেন, ‘দুজনই শুধু টাকা কামিয়েছেন। একেকজনের হাজার কোটি টাকার নিচে সম্পদ নেই।’
উন্নয়নের চেয়ে টাকা বাগাতে ব্যস্ত ছিলেন দারা-মুনসুর
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক দুই এমপিও পলাতক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনবার এমপি হয়েছেন সাবেক সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। এর আগেরবার এমপি ছিলেন মুনসুর রহমান।
অভিযোগ রয়েছে, দারা ২০০৮-১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পুঠিয়া-দুর্গাপুরে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতি করে। কথিত রয়েছে, কমিশনের টাকা আদায়ে তাঁর ভাই সুজাউদ্দিন ব্যাগ নিয়ে গিয়ে দুর্গাপুরে বসে থাকতেন ওই সময়।
সাবেক এমপি মুনসুরও একইভাবে ২০১৮-২৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি টাকা রাখার জন্য বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে সিন্দুক করেছিলেন।
পুঠিয়ার বানেশ্বরের আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘দুই এমপি শুধু নিজেদের উন্নয়ন করেছেন। এলাকার কোনো উন্নয়ন করেননি। তাঁরা এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজন মিলে লুটপাট করে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। এখন তাঁরা দুজনেই পলাতক।’