অনিয়ম ও দুর্নীতির রেকর্ড গড়েছেন ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। ওয়াসার জাদুকরী চেয়ারে বসে গত ১৫ বছরে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন তিনি। বিদেশী ঋণে বড় বড় প্রকল্প, সেবার নামে মানহীন পানি সরবরাহ, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এসব টাকা কামিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। এই টাকায় তিনি দেশে নয়, সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি আলিশান বাড়ি কিনেছেন।
এসব বাড়ির মূল্য হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। তিনি এবং তার স্ত্রী-সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনা এবং অর্থ পাচারকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাকসিম খানের নাম থাকা নিয়ে দুটি অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
এদিকে ২০০৯ সাল থেকে তার পদত্যাগ পর্যন্ত এমডি থাকা অবস্থায় তার লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ সময়ে তিনি পানির দাম ১৬ বার বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তৈরি করেছেন। বর্তমানে তিনি দেশে না বিদেশে পালিয়েছেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্নে উঠেছে। তাকসিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও প্রতিবারই দায়মুক্তি সনদ (ক্লিন সার্টিফিকেট) দিয়ে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তাকসিম এ খানকে ওয়াসার এমডি পদ থেকে বৃহস্পতিবার বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর পরই তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এদিকে বহুল আলোচিত ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ সংক্রান্ত চিঠি আদালত ও পুলিশের বিশেষ শাখায় দিয়েছেন।
ছয় হাজার কোটি টাকা লোপাট ॥ তাকসিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে অভিযানে নেমেছে দুদক। দুজন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাকসিমসহ ১০ জনের নামে শীঘ্রই মামলা করবে দুদক। এরই মধ্যে দুদক কিছু তথ্য-প্রমাণ হাতে পেয়েছে। দুদক উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিশেষ একটি দল ওই অভিযোগ অনুসন্ধান করে।
তারা ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দুদক প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মামলার অনুমোদন দেবে।
সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না তাকসিম এ খানের। তবু ২০০৯ সালে তৎকালীন ওয়াসা বোর্ড তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে এমডি পদে বসায়। সেই থেকে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিমের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়। এরপর ওয়াসায় শুরু হয় তাকসিম আমল। গত ১৫ বছরে তার বিরুদ্ধে ছয় হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
ওয়াসাকে দুর্নীতিতে ডুবিয়েছেন তাকসিম ॥ ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর থেকে টানা ১৫ বছর ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মোট সাতবার তার পদের মেয়াদ বাড়িয়েছে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এমডি হিসেবে তাকসিমের সর্বশেষ মাসিক বেতন ছিল ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির মধ্যে এক লাফে তার বেতন বাড়ানো হয় পৌনে দুই লাখ টাকা।
তৎকালীন সরকারের এক প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে শত দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও তাকসিম এই পদে দাপটের সঙ্গে ছিলেন। সরকার পতনের পর গত ১৫ আগস্ট তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম যুগের অবসান ঘটে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করা হয়।
ওয়াসার তাকসিম সা¤্রাজ্যে বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে বলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার অজুহাতে বড় বড় প্রকল্প নেন তিনি। এরপর বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন তাকসিম।
পানির চাহিদা মেটানোর কথা উল্লেখ করে ২০১৯ সালের জুনে ‘পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প’ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের সময় জানানো হয়, এই পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে। খরচ করা হয় তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফল না এলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ঋণ করতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে।
তাকসিমের দুূর্নীতির থাবায় ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্য পাইপ লাইনের মাধ্যমে শোধন করে বালু নদীতে ফেলার লক্ষ্যে আফতাবনগরে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। গত বছর দাশেরকান্দি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। তিন হাজার ৪৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পেরও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্যরে কথা বলা হলেও বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ড্রেনেজের বর্জ্য। এখানেও বড় অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের জন্য অনেক টাকা ঋণ করতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে। সব মিলিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা (যশোলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তাকসিম চক্র।
প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। শোধনাগারের প্ল্যান্ট চালু রাখতে হাতিরঝিলের ময়লা পানি সেখানে নিয়ে শোধন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা, ২০২৭ সালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮২৫ কোটি টাকা।
পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পেও হয়েছে দুর্নীতি। মূল সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নিম্নমানের পানি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।
ঐক্য পরিষদের নেতাদের হিসাব মতে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে সংস্থার সিস্টেম লস ছিল ৩৪.৮২ শতাংশ এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৮২ শতাংশ।
সমবায় আইন অমান্য করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি থেকে ৬২১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এ ছাড়া সমিতির মালামাল বিক্রি করা হয়েছে। তার আনুমানিক মূল্যও প্রায় শতকোটি টাকা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা লোপাটের প্রতিবেদন এসেছে। প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হওয়ায় তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সে সময়। তার সময়কালে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় ঢাকা ওয়াসা থেকে।
এখনো রয়ে গেছে দুর্নীতির বলয় ॥ ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে কথা বললেই সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি খোয়াতে হতো। গত বছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ওয়াসার এমডির স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগের মূল বিষয় ছিল তাকসিম এ খানের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। তাকসিম নিজের ইচ্ছামতো ওয়াসা চালান এবং যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের তিনি বরখাস্ত করেছেন।
কিন্তু ওয়াসা থেকে তাকসিম পদত্যাগ করলেও তার দুর্নীতির সুবিধাভোগী বলয় এখনো রয়ে গেছে। এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র অসন্তোষ। নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হতো তাকসিমের অনুসারী জুনিয়র অফিসারদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা ওয়াসার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, যারা এমডির কথা শুনেছে, তার দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছে তারা সব সময়ই ঢাকা ওয়াসায় সুবিধা পেয়ে এসেছে, জুনিয়র হয়েও পুরস্কৃত হয়েছে।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনো তাদের পদে থেকে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। স্বচ্ছ ওয়াসা গঠনে তাদেরও অপসারণ করতে হবে। এখনো তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন সৎ কর্মকর্তারা। এমডির পাশাপাশি ওই কর্মকর্তাদেরও ওয়াসা থেকে সরাতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে বেশ কিছু দিন ধরে বিক্ষোভ করে আসছেন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমডিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছেন তারা।