সংকট উত্তরণে বৈশ্বিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইওএম)৷
২৮ এপ্রিল (সোমবার) আইওএম এর মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে৷ সেখানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে৷
পরদিন, মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, অভিবাসন রুটে প্রাণ হারানো বেশিরভাগ মানুষই নিজের ইচ্ছায় বিপজ্জনক যাত্রা বেছে নেননি৷ বরং হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘাত, দুর্যোগ এবং অন্যান্য মানবিক সংকটের কারণেই পালাতে বাধ্য হয়েছেন তারা, বেছে নিতে হয়েছে বিপজ্জনক পথ৷
এই সময়কালে ৩৯ হাজারেরও বেশি মানুষ সংকট অঞ্চলে মারা গেছেন৷ আইওএম জানিয়েছে, প্রাণ হারানো এসব মানুষেরা নিজ দেশেই অনিরাপদ পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছিলেন৷ আর ১৩ হাজার পাঁচশো জনেরও বেশি মানুষ সংঘাত বা দুর্যোগ থেকে পালাতে গিয়ে মারা গেছেন৷
প্রতিবেদনে ‘সংকট কবলিত দেশ’ বলতে ৪০টি দেশকে বুঝিয়েছে আইওএম৷ এর ব্যাখ্যায় সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইওএম অথবা জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ইউএনওসিএইচএ-এর তালিকাভুক্ত ৪০টি দেশকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে ক্রাইসিস রেসপন্স প্ল্যান (সিআরপি) বা হিউম্যানিটেরিয়ান রেসপন্স প্ল্যান (এইচআরপি) কার্যকর রয়েছে৷
এই ১১ বছরে সবেচেয়ে বেশি মারা গেছেন আফগানিস্তানের নাগরিকেরা৷ দেশটির অন্তত পাঁচ হাজার ৪৬ জন মানুষের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে আইওএম৷ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী৷ তিন হাজার ১৪৯ রোহিঙ্গার মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয়েছে৷ তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ার এক হাজার ৯২৩ জন এবং চতুর্থ স্থানে থাকা সিরিয়ার এক হাজার ৪৩৩ জন নাগরিকের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে আইওএম৷
তালিকার দশম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম৷ এই ১১ বছরে অভিবাসন রুটে দেশটির ৩৪৬ জন নাগরিকের মৃত্যু নথিভুক্ত করেছে আইওএম৷
আইওএম-এর মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, “এই সংখ্যাগুলো একটি দুঃখজনক পরিস্থিতিকে তুলে ধরে৷ যখন নিরাপত্তাহীনতা, সুযোগের অভাব এবং অন্যান্য চাপের কারণে নিজ দেশেও কোনো নিরাপদ বা কার্যকর বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায় না, মানুষ তখনই জীবনের ঝুঁকি নেয়৷’’
অ্যামি পোপ আরো বলেন, ‘‘আমাদেরকে অবশ্যই সমাজের মধ্যে স্থিতিশীলতা এবং সুযোগ তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে অভিবাসন একটি বিকল্প হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়তা যেন না হয়৷ কিন্তু যখন একটি জায়গায় আর কোনোভাবেই থাকা সম্ভব হবে না, তখনই মানুষ ঝুঁকি নেবে৷ এজন্য আমাদের অবশ্যই জীবন বাঁচাতে নিরাপদ, আইনি এবং নিয়মিত পথ তৈরিতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে৷’’
২০২৪ সালে অভিবাসী মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে আইওএম৷ গত এক বছরেই মারা গেছে প্রায় নয় হাজার অভিবাসী৷ ২০২৪ সালকে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং সেন্ট্রাল অ্যামেরিকার অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হিসাবে আখ্যায়িত করেছে সংস্থাটি৷
সংকট অঞ্চল: অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ
আইওএম জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে রেকর্ড করা অভিবাসী মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি (৫৪ শতাংশ) হয়েছে সংঘাত বা দুর্যোগ আক্রান্ত দেশগুলোতে বা তার কাছাকাছি কোনো স্থানে৷
২০২১ সালে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ মারা গেছেন৷
বাংলাদেশ ঢোকার সময় এবং নৌকাডুবি মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত তিন হাজার একশো জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন৷
সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরকে এখনও বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিবাসন রুট হিসাবে চিহ্নিত করেছে আইওএম৷ এই রুটে ২০১৪ সাল থেকে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন৷
বৈশ্বিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার আহ্বান
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক সংকট তীব্রতর হলেও মানবিক পরিকল্পনায় অভিবাসীদের বেশিরভাগ সময়ই উপেক্ষা করা হয়৷ উদ্বাস্তু মানুষের চাহিদা মূল্যায়ন এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতারও অভাব রয়েছে৷
আইওএম বলছে, মারা যাওয়া বা নিখোঁজ অভিবাসীদের প্রতি চার জনের মধ্যে একজন সংকট কবলিত দেশের নাগরিক৷
আইওএম-এর মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্টের সমন্বয়কারী এবং এই প্রতিবেদনটির লেখক জুলিয়া ব্ল্যাক বলেছেন, ‘‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন৷’’
অভিবাসী মৃত্যুর সঠিক তথ্য পাওয়াও কঠিন বলে জানান তিনি৷ জুলিয়া ব্ল্যাক বলেন, ‘‘বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্র এবং দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত আমরা যা রেকর্ড করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি৷’’
এমন বৈশ্বিক বাস্তবতায় অভিবাসীদের সংকটে সাড়া দিতে রাষ্ট্র এবং মানবিক অংশীদারদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে আইওএম৷ এর অর্থ হলো অভিবাসনে আইনি পথের সুযোগ বাড়ানো, সহযোগিতা এবং স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বড় করা৷ একইসঙ্গে তথ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়ানোর উপরও জোর দিয়েছে আইওএম৷ সংস্থাটি বলছে, এতে করে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের আরো ভালভাবে ট্র্যাক এবং সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে৷