রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৮ পূর্বাহ্ন

হ‍ুম‍ায়ূনের সমুদ্র বিলাসে শাওনের রিসোর্ট

  • আপডেট সময় বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪

এইমাত্র ঝুপ করে সাগরে ডুবে গেলো সূর্যটা। সেদিকে খুব একটা মন নেই ওসমান গণির। ছোট ছোট কটেজ সারির ওপাশে টেবিল চেয়ার পেতে কাজে মগ্ন তিনি। পাশে জাল বুনছেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক।

সৈকতের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে বাঁশের বেড়ার এপাশ থেকে একটানা হাঁক দিয়েও কাজ হলো না। মুখ তুললেন বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফের কাজে মনোযোগী ওসমান গণি। এমন মুডি মানুষকে অবশ্য এখানে তেমন একটা বেমানান লাগলো না।

কালজয়ী কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘সমুদ্র বিলাস’ এর কেয়ারটেকার তিনি। মুড তো এমন হতেই পারে। ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিতে তাই চলতে থাকলো একটু কাছে আসার অনুনয়। ভাবটা এমন যে, আপনার কাছেই তো এসেছি ভাই। অতিথি নারায়ণকে তবে কেনো এতো অবহেলা!
শেষ তক, লাগাতার লেগে থাকার ফল পাওয়া গেলো। হাতের কাজ গুটিয়ে গদাই লস্করি চালে এগিয়ে এলেন ওসমান গণি। কথা শুরু করতেই বোঝা গেলো, আসলে আলাপি মানুষই তিনি। একটু একটু করে মেলতে লাগলেন নিজেকে। মাঝে বাঁশের বেড়ার গেট থাকলেও ক্রমশই গভীর হতে থাকলো ভাব।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে থাকেন ওসমান গণি। অতীতের গল্পজুড়ে বলেন, এখানে ২২ শতক জমি ছিলো তার দাদি জুলেখা খাতুনের। সেই জমি তিনি দিয়েছিলেন তার ছেলে (ওসমানের বাবা)হোসেন আহমেদকে। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৬ হাজার টাকায় সেই জমি কিনে নেন হুমায়ূন আহমেদ। কটেজ গড়ে তার নাম দেন ‘সমুদ্র বিলাস’। পরবর্তীতে হুমায়ূন ভক্তদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্র বিলাসের গল্প। সেন্টমার্টিনে আসা পর্যটকরা মহাকৌতূহলে ছুটে আসেন এখানটায়।

গল্পে গল্পেই মনটা বুঝি আর একটু নরম হয় জমির উত্তরাধিকার থেকে সমুদ্র বিলাস এর কেয়ারটেকার বনে যাওয়া ওসমান গণির। একটু পরই মেলে ছবি তোলার অনুমতি। তবে সামনের গেট খুলতে রাজি হন না তিনি। পাশে কেয়া ঝোপের পাশ দিয়ে সরু গলিটা দেখিয়ে বলেন পেছনে যেতে।

দক্ষিণের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই জাল বোনা অসমাপ্ত রেখে পেছনের ঘরে সেঁধিয়ে গেলেন ওসমান গণির স্ত্রী ইয়াসমিন হক। সেন্টমার্টিনের আর সব নারীর মতোই লাজুক চোখে নজর রাখেন দরোজার আড়াল থেকে।

তারা যেখানটায় আড়াল নিয়েছেন সেটি একটা দোতলা ভবন। ওসমান গণি জানালেন, নিচের ওই বড় ঘরটায় লাইব্রেরি করার ইচ্ছা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের। আর ওপরের খোলা দোতলায় করতে চেয়েছিলেন রেস্টুরেন্ট। কিন্তু অমোঘ নিয়তি তাকে সে সময় দেয়নি।
সামনে দু’দিকে ৩টি করে মোট ৬টি কটেজ। সব নন এসি। ভাড়া এক রাতের জন্য দেড় হাজার টাকা। তবে সরকারি ছুটির দিনে ডাবল হয়ে যায় কটেজের ভাড়া। লাগোয়া ফ্রেশরুমসহ মাত্র একটি করেই রুম আছে প্রতিটি কটেজে।

আগে ছিলো তিন রুমের কেবল একটি কটেজ। তাতে থাকতেন হুমায়‍ূন আহমেদ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মারা যাওয়ার মাত্র সাত মাস আগে এখানে সর্বশেষ এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেদিন ছিলো ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। সঙ্গে ছিলেন শাওন। মাত্র এক রাত ছিলেন সেবার।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর লিজ দেওয়া হয়েছিলো সমুদ্র বিলাস। সম্প্রতি শাওন বাতিল করে দিয়েছেন লিজ। ১৬ হাজার টাকার জমির দাম বেড়ে এখন প্রতি শতকের দাম হয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। আগের ২২ শতকের সঙ্গে গেলো বছর (২০১৫) সমুদ্র বিলাসের ঠিক পেছনেই ৬০ লক্ষ টাকায় আরো ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন শাওন। এই ৫২ শতকের ওপর কি তাহলে আধুনিক কোনো রিসোর্ট গড়বেন তিনি?

হতে পারে। তবে স্পষ্ট করে সে কথা বলতে পারেন না ওসমান গণি। সামনে কটেজগুলোকে ঘিরে সাগর বাতাসে মাথা দুলাতে থাকা গোটা তেরো নারিকেল গাছ ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি তখন সামনের সৈকতে।

একটু পরই জোয়ার আসবে। তখন বালুময় সৈকতের হাঁটু পানিতেই জাল ফেলবেন তিনি। এক থেকে দেড় ঘণ্টা জাল ফেললে কেজি তিনেক টেংরা মাছ ধরা যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী ওসমান গণি।

আগে তার শুটকির দু’টি দোকান ছিলো এদিকটায়। বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। এখন সৈকতে ছাতা ভাড়া দেন প্রতি ঘণ্টা ৩০ টাকায়। মৌসুম নয় বলে ওই আয়ও বন্ধ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এ মাসে কোনো ভাড়াই পায়নি সমুদ্রবিলাস। তবু নিজভূমে পরবাসী ওসমান গণিকে আগলে রাখতে হয় বাপ-চাচার ভিটেয় গড়া অন্যের কটেজ।

সোজা পশ্চিমমুখো কটেজের সামনে অবারিত সমুদ্র। বর্ষায় জোয়ারের প‍ানি এসে মাথা ঠোকে কটেজের গোড়ায়। তখন পা বাড়ালেই সাগর ঠেকে। এখন বর্ষার মৌসুম না হলেও কয়েক ফুট দূরে এসে আছড়ায় ছন্দবদ্ধ ঢেউ। রাত দিন ২৪ ঘণ্টাই এখানে কানের কাছে গান শোনায় সাগর। সেদিকে তাকিয়ে ওসমান গণি কি ভাবতে থাকেন কে জানে!

কটেজের সামনে একটু বাঁয়ে একটা টঙ দোকান অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে সমুদ্র বিলাসকে। পানে একটা সাইনবোর্ডে সতর্কীকরণ বার্তা লিখে রেখেছে নৌবাহিনী। তাতে লেখা-কারেন্ট: সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

একটু এগিয়ে কোনা ঘুরলেই উত্তর সৈকত। সেন্টমার্টিনের ডেনজার জোন। সাগরে নেমে পর্যটকদের মৃত্যুর অধিকাংশ ঘটনাই ওই উত্তর সৈকতের।

তবে সমুদ্র বিলাসের মুখ সোজা পশ্চিমে। কটেজে থেকেই তাই অবলোকন করা যায় সূর্যাস্তের অপরূপ রূপ। কোরাল বনে আছড়ে পড়ে ফেউ ভাঙ্গে চোখের সামনে। পানির ওপর হুপোপুটি খায় পানির ফেনা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কালচে বর্ণ নিয়েছে সাগরের স্রোত। সমুদ্র বিলাসের সামনে তবু সেলফিপ্রেমিদের ভিড়। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিকেই যেনো সেলফিতে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছেন সবাই।

এমনই এক সেলফি প্রত্যাশী নারায়ণগঞ্জের নাজির আহমেদ। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, সব বাড়ি বাড়ি নয়। সেন্টমার্টিনে এসে এ বাড়িটা দেখে ভালো লাগছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com