তার বয়স যখন ১৫ বছর, তখন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নামক রোগ ধরা পড়ে। এরপর থেকে একটানা কয়েক বছর ধরে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ওষুধের উপর বেঁচে ছিলেন তিনি। অথচ ১৫ বছরের আগে তিনি ছিলেন দুরন্ত, হাস্যজ্জ্বল, খেলাধুলায় পারদর্শী। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি হয়ে পড়েন শয্যশায়ী।
যদিও তার মনে সাহস ছিল প্রবল, ভেবেছিলেন সুস্থ হয়ে উঠবেন। আবারও খেলাধুলা করবেন, বিশ্ব ঘুরে দেখবেন। মনের জোরে তিনি সুস্থ হলেন ঠিকই কিন্তু পঙ্গুত্ববরণ করলেন। এরপর তার একমাত্র ভরসা হুইল চেয়ার।
বলছি, মুম্বাইয়ে বসবাসকারী ৫২ বছর বয়সী পারবিন্দর চাওলার কথা। তিনি এরই মধ্যে হুইলচেয়ারে বসেই বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করে রেকর্ড গড়েছেন। কারও সাহায্য ছাড়াই একা একা, তাও আবার হুইলচেয়ারে বসে তিনি ঘুরেছেন বিশ্বের নানা দেশে।
তার মুখের হাসি দেখেই হয়তো বুঝতে পারছেন তার মনের জোর কত। পায়ের জোর না থাকলেও মনের জোর দিয়ে আজও তিনি সব বাধা অতিক্রম করে যাচ্ছেন।
তাইওয়ানের প্যারাগ্লাইডিং থেকে অস্ট্রেলিয়ায় স্নরকেলিং, ৫২ বছর বয়সী পারবিন্দর চাওলা হুইলচেয়ারে বসে প্রথম ঘুরতে গিয়েছিলেন বৈষ্ণো দেবীতে। তবে তার সঙ্গে ছিল কয়েকজন বন্ধু। তবে তিনি কীভাবে মন্দিরে ঢুকবেন, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিল।
তবে চারজনের সহযোগিতায় তিনি ঠিকই মন্দিরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। পারবিন্দর বলেন, ‘যদিও আমি সেদিন ওই মন্দিরে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যাইনি, তবে পুরোহিত যখন আমাকে দেখেন তখন দেবীর দর্শন পাওয়ার জন্য পথ তৈরি করে দেন। আর ও সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল যে পৃথিবী খুলে গেছে।’
তার ঠিক কিছু দিন পরই দুবাই ভ্রমণের সুযোগ পান পারবিন্দর। তিনি বলেন, ‘দুবাই একটি হুইলচেয়ার-বান্ধব জায়গা। অন্যদিকে চীনে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া চীনে ভাষাগত জটিলতা ও পরিবহন সুবিধাও ততটা ভালো নয়। চীন মোটেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি বান্ধব দেশ নয়।’
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে ক্ষেত্রবিশেষে অন্যের সাহায্যের উপর স্বাভাবিকভাবেই নির্ভর করতে হয় পারবিন্দরকে। যেমন- লিফট না থাকলে সিঁড়িতে ওঠা কিংবা প্যাঁচানো রাস্তা বা নুড়ি-পাথরযুক্ত রাস্তায় হুহুইলচেয়ার নিয়ে চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এরপর পারবিন্দর চাওলা বালিতে একক ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রুম সার্ভিস ছাড়াই একটি রুমে থেকেছি আমি। ওই একক ট্রিপটি আমাকে আমার নিজের মতো করে বিশ্ব দেখার সাহস দিয়েছে, অন্য কারও উপর নির্ভর করে নয়।’
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিরও শিকার হয়েছেন তিনি। তবুও মনে সাস জুগিয়ে সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন এই নারী। চীন ভ্রমণে যাওয়ার আগে তিনি একটি হোটেল প্রি-বুক করে রেখেছিলেন।
তবে সেখানে পৌঁছানোর পর তার বুক করা রুম তিনি না পেয়ে অন্য হোটেলের সন্ধানে বের হতে হয় তাকে। অতঃপর সেখানকার স্থানীয় একজনের সাহায্য নিয়ে অবশেষে কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করেন।
আরও এক খারাপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন পারবিন্দর। তিনি বলন, ‘ইতালির রোম ভ্রমণের সময় আমার কাছ থেকে বেশ অনেকগুলো টাকা চুরি হয়ে যায়। তারপরও আমি তা সামলে নিয়েছি। এমনকি ভারতে রাস্তায় চলার সময় হুইলচেয়ারবান্ধব বাথরুম খুঁজে পাওয়াও একসময় কঠিন ছিল। এসব অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে আরও স্থিতিস্থাপক ও সাহসী করে তুলেছে।’
এমনকি করোনা মহামারির সময়ও তিনি ঘরবন্দি থাকেননি। তিনি তার স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে চড়ে নিজ দেশ আবিষ্কার করতে রওনা হন। একে একে তিনি জয়পুর, আগ্রার মতো শহরগুলো ভ্রমণ করেন। ভ্রমণর পাশাপাশি তিনি ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে ওই সময় ক্যাপচার করে রাখতেও পছন্দ করেন।
পারবিন্দর আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আরও অনেক পথ বাকি আছে আমার। ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে কিছু মৌলিক বিষয় আছে। জয়পুরে গিয়ে আমি হাওয়া মহলের শীর্ষে যেতে পেরেছি হুইলচেয়ারে বসেই। এটি একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল। আগ্রাও অনেকাংশে প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে উঠেছে।’
পারবিন্দরের একটি লক্ষ্য আছে, আর তা হলো- তার পাসপোর্টে যেন বিশ্বের সব দেশের স্ট্যাম্প থাকে। বিগত কয়েক বছরে তিনি মোট ৫৯টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাইওয়ানে প্যারাগ্লাইডিং থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের উডুপিতে কায়াকিং ও ইউরোপজুড়ে ব্যাকপ্যাকিংয়ের মতোসব সব কর্মকাণ্ড করেছেন তিনি।
পারবিন্দর তার জীবনের গল্প ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়মিত শেয়ার করেন তার ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ হয়েও যে মনের জোরে এতো কিছু করা যায়, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেন পরবিন্দর চাওলা।
তার চাওয়া একটিই, আর তা হলো পুরো বিশ্ব যেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষবান্ধব হয় ও তাদের প্রতি যেন সবাই যত্নবান হন। তাহলেই তারা বোঝা নয় সমাজের সম্পদ হতে পারবে।
সূত্র: আউটলুক ট্রাভেলর