বিয়ের আগে মানুষের মাথায় প্রথম চিন্তাটা আসে মধুচন্দ্রিমা কোথায় করবে। অনেক নব-দম্পতি ভ্রমণগুরু পেইজে মেসেজ করে জানতে চান দেশের মধ্যে হানিমুনে কোথায় যাবেন। কারো হয়তো ভালো লাগে সমুদ্র, কারো বা পাহাড়, কারো শুধুই নির্জনতা। নব-দম্পতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করে নিবেন কোথায় যাওয়া যায়। এই আলোচনায় সাহায্য করার জন্য দেশের মধ্যে হানিমুনের সেরা গন্তব্যগুলো নিয়ে এই আর্টিকেল।
কক্সবাজার: সমুদ্রের পছন্দ করেনা এমন মানুষ পাওয়া বিরল। আমদের দেশটা ছোট হলেও এদেশেই রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। আপনি হয়তো বন্ধু-বান্ধবের সাথে অনেকবার কক্সবাজার ভ্রমণ করে ফেলেছেন, কিন্তু তবুও প্রিয়তমার সাথে প্রথমবার কক্সবাজার ভ্রমণ হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ভ্রমণ। ফলে বাংলাদেশের মানুষের হানিমুন গন্তব্যের শীর্ষে আছে কক্সবাজার।
কক্সবাজারে হানিমুনের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে অসংখ্য হোটেল/রিসোর্ট আছে যারা হানিমুনের বিষয়ে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ। তাদের হানিমুন প্যাকেজ নিয়ে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারেন। অথবা নিজে চাইলেও চমৎকারভাবে আয়োজন করে নিতে পারেন নিজের মতো হানিমুন প্যাকেজ। কক্সবাজারের আরেকটা সুবিধা বিমান চলাচল করে, তাই চাইলে বিমানে যেয়ে সড়কপথের ক্লান্তি এড়িয়ে ভালমতো উপভোগ করতে পারবেন সময়।
অনেকে কক্সবাজারে বেশি ভিড়ের কারণে হানিমুন সেখানে করতে চান না। তারা চাইলে কক্সবাজার শহরের মূল সমুদ্র সৈকতগুলো (লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী সৈকত) বাদ দিয়ে বেঁছে নিতে পারেন প্যাঁচার দ্বীপ (হিমছড়ি) বা ইনানী সমুদ্র সৈকত। সেখানে মারমেইড বিচ ও ইকো রিসোর্ট, সাম্পান, পেবলস্টোন সহ বেশ কিছু চমৎকার রিসোর্ট রয়েছে যেগুলো হানিমুনের জন্য হতে পারে চমৎকার জায়গা।
সেন্টমার্টিন: দারুচিনির দ্বীপ সেন্টমার্টিনের নাম শুনলেই অনেকের মধ্যে রোমান্টিসিজম কাজ করা শুুরু করে। চোঁখ ধাধানো তীব্র নীল পানি আর নারকেল গাছের সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশে আর কোথাও পাওয়া যায়না। সেন্টমার্টিনের প্রতি তাই অনেকের রয়েছে অন্যরকম আবেগ। হানিমুনের গন্তব্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয় অপূর্ব সুন্দর এ দ্বীপটি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এ দ্বীপে আপনি চাইলে সারারাত সৈকতে কাটিয়ে দিতে পারেন, নিরাপত্তার কোন সমস্যা নেই।
শীতকাল ছাড়া বছরের অন্য সময় সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকেনা। মোটামুটি অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে মার্চ পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে দ্বীপটি। আর চাইলে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার পর্যন্ত বিমানে যেয়ে সেখান থেকে সরাসরি বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে সরাসরি পৌছাতে পারবেন সেন্টমার্টিন। আর সমুদ্র সৈকতে দারুণ সব রিসোর্টগুলোর কোন একটি বেছে নিতে পারেন। নির্জনতার দরকার পড়লে উত্তর সৈকতের কোন রিসোর্টে উঠতে পারেন।
সাজেক: বর্তমানের সময়ের জনপ্রিয় হানিমুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে সাজেক। আমার দৃষ্টিতে সাজেক বাংলাদেশের মধ্যে হানিমুনের অন্যতম সেরা গন্তব্য। আপনি যদি পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা এসব পছন্দ করেন, তবে হানিমুনের গন্তব্য হিসেবে সাজেককেই বেছে নিতে পারেন। খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বিলাসবহুল এসি বাস চলে। সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে (জীপ গাড়িতে) চড়ে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে পৌছাতে হবে ১,৮০০ ফুট উঁচু সাজেকে।
পাহাড়ের চূড়ায় মাত্র ২ কিলোমিটার এলাকা সাজেক ও কংলাক পাড়া। পাহাড়ের কোলঘেষে রয়েছে অসংখ্য রিসোর্ট। এর মধ্যে বারান্দা থেকে মেঘ-পাহাড়ের মিতালী দেখা যায় এরকম একটি রিসোর্ট বেছে নিবেন। ভাগ্য ভালো থাকলে সকালে উঠে রিসোর্টের বারান্দায় আসলে দেখা মিলবে মেঘ ঢেকে ফেলা উপত্যকা। গরমের সময়েও সাজেকে হাল্কা ঠান্ডা বাতাস বয়। আর মাঝে মাঝে পুরো সাজেকই চলে যায় মেঘের আড়ালে।
সকালে হেটে চলে যেতে পারবেন কাছের কংলাক পাড়ায়, সূর্যদয়টা কংলাকের চূড়া থেকে সবচেয়ে ভালো উপভোগ করা যায়। সাজেকে বেশ কিছু চমৎকার রেঁস্তোরা আছে। ফুডাংকি, মনটানা, বিসমিল্লাহ তে চেখে দেখতে পারেন ব্যাম্বু চিকেন। ভালো হয় উইকএন্ড এড়িয়ে হানিমুনের দিনক্ষণ ঠিক করলে। তাহলে ভিড় খুব কম পাবেন এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো চারোপাশটা উপভোগ করে আসতে পারবেন।
শ্রীমঙ্গল: ছোট ছোট টিলার গায়ে দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান আর তার মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল সব গাছের দৃশ্যটি আমাদের অনেকের পরিচিত। চায়ের রাজধানী মৈালভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, দেশের মধ্যে হানিমুনের জন্য চমৎকার একটি জায়গা। শ্রীমঙ্গলের রাধানগর এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য রিসোর্ট। রয়েছে বিলাসবহুল গ্র্যান্ড সুলতান এর মতো ফাইভস্টার রিসোর্টও। এছাড়া দু-সাই, নভেম, বালিশিরা, শান্তিবাড়ি, হিমাচল সহ অনেকগুলো রিসোর্ট।
চা-বাগানের মধ্যে মেঠো পথে পথচলা, চাইলে বাইক্কা বিলে নৌকা ভ্রমণ অথবা কাছের লাউছড়া বন থেকে ঘুলে আসতে পারবেন। আর একটু দূরেই রয়েছে পাহাড় বেষ্টিত নয়নানিভারম লেক মাধবপুর লেক। যারা একটু ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলিতে কোন জায়গায় থাকতে চান তারা যেতে পারেন শ্রীমঙ্গলের পার্শ্ববর্তী উপজেলা কমলগঞ্জের টিলাগাঁও ইকো ভিলেজে। আর স্বামী-স্ত্রী দুজনই অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন চলে যেতে পারে হামহাম ঝর্ণায়!
বান্দরবান: আমার মতো অনেকেই আছেন যাদের সবচেয়ে আবেগের জায়গা বান্দরবান। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যদি ভ্রমণপ্রিয় হয়ে থাকেন তবে বান্দরবান তাদের কাছেও প্রিয় হবার। হানিমুনের জন্য তাই অনেকে বেছে নেন বান্দরবান জেলাকে। ট্যুরিস্ট ডিস্ট্রিক্ট বান্দরবান শহর ও তার আশেপাশে আছে সুন্দর সুন্দর সব রিসোর্ট। এর মধ্যে সায়রু নি:সন্দেহে সবচেয়ে সেরা। এছাড়া কম খরচের মধ্যে রয়েছে গ্রীন পিক রিসোর্ট, বনবিলাস রিসোর্ট, হলিডে ইন, এসেন্স ইকো রিসোর্ট, মিলনছড়ি হিলভিউ রিসোর্ট সহ অসংখ্য রিসোর্ট।
রাঙ্গামাটি: তুলনামূলক কম আলোচনায় আসলেও রাঙ্গমাটি কিন্তু হানিমুনের জন্য চমৎকার গন্তব্য। শহরের পলওয়েল রিসোর্টের বারান্দা থেকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির ছবি সবার চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। শীতের সময় কাপ্তাই লেকের নীল পানির পটভূমিতে সবুজ পাহাড় আর ততোধিক নীল আকাশ আপনার মধুচন্দ্রিমাকে স্মরণীয় করে রাখবে। রাঙ্গামাটি শহর, আসাম বস্তি এলাকা, কাপ্তাইয়ে রয়েছে চমৎকার সব রিসোর্ট। এদের মধ্যে আরণ্যক, বেরাইন্যা লেক রিসোর্ট, ডিভাইন রিসোর্ট অন্যতম।
কুয়াকাটা: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য হানিমুনের চমৎকর জায়গা হতে পারে কুয়াকাটা। পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত কুয়াকাটা বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যদোয় দুটোই দেখা যায়। ঢাকা থেকেও এখন পদ্মা সেতু হয়ে খুব সহজে চলে যাওয়া যায় এ সৈকতে। বর্তমানে কুয়াকাটাতেও আছে দারুণ সব হোটেল ও রিসোর্ট। এসবের মধ্যে হোটেল কুয়াকাটা গ্র্যান্ড ও শিকদার রিসোর্ট অন্যতম।
সিলেট: বর্তমান সময়ে মধুচন্দ্রিমার জন্য সিলেট গন্তব্য হিসেবে পিছিয়ে পড়েছে কিছুটা। তারপরও সিলেট বাংলাদেশে অন্যতম সেরা হানিমুন ডেস্টিনেশন বলা যায়। জাফলংয়ের পিয়াইন নদী, মায়বী রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, লালা খালের অদ্ভূত সুন্দর সবুজাভ নীল পানি, খাদিমনগরের চা বাগান, আর শহরের কিন ব্রীজ সব মিলে আপনার মধুচন্দ্রিমা হয়ে উঠবে মরে রাখার মতো।
সিলেটে রিসোর্ট ও অভিজাত হোটেল দুটোই আছে। শুকতারা নেচার রিট্রিট, নাজিমগড় গার্ডেন রিসোর্ট এর পাশাপাশি হোটেল রোজ ভিউ, গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল এন্ড রিসোর্ট, নির্ভানা ইন, নভেম ইন সহ অসংখ্য হোটেল আছে। চাইলে শহর থেকে দূরে লালাখালে নাজিমগড় ওয়াল্ডারনেস রিসোর্টেও থাকতে পারেন।
মিঠামইন: হাওর অঞ্চলেও হতে পারে ব্যতিক্রমী মধুচন্দ্রিমার গন্তব্য। অনেক সময় দেখা যায় নব-দম্পতির উপরের সব জায়গায় ঘোরা হয়ে গেছে, তখন চাইলে মিঠামইনের মতো চমৎকার জায়গায় যেতে পারেন হানিমুনে। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর হাওরে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। এ সময় হাওরের মাঝে গড়ে উঠা প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে চলে যেতে পারেন। প্রতিটি রুমের বারান্দা থেকে দেখতে পাবেন হাওরের অপূর্ব রূপ।