এখানে জলের শর্তে বাঁধা সবকিছু। কি উদ্ভিদ, কি মানুষ, কি প্রাণবৈচিত্র্য—সবাই। এক শীত-বসন্ত পার হয়ে সে এক নতুন পরিবেশ, চিরচেনা কিন্তু নতুনই। ধু ধু শুকনা প্রান্তর একদিন জলের কলকল করা কুমারী ঢল এসে ভরিয়ে তোলে। যেখানে সবুজ ঘাসের দেশে এত দিন গরু চরে বেরিয়েছে। সাদা বকের ঝাঁক, দূরদেশের ভ্রমণক্লান্ত পাখিরা এক বিল থেকে অন্য বিলে উড়ে চলেছে। সেখানে তখন অথই জলের ছোট-বড় ঢেউ, ছলছলাৎ করে আত্মহারা ঢেউয়েরা একে অন্যের ওপর ঢলে পড়ে। চোখের পলকেই খাল-বিল, মাঠ, পথঘাট সব ডুবে হাওর-সীমান্তে পৌঁছায়।
কিছু কষ্ট, কিছু দুর্ভোগ মেনে নিয়েই প্রহরজুড়ে এখানে টিকে থাকার নিঃশব্দ ছুটে চলা আছে। আছে এই জলেরও এক নীরব-গোপন সুখ। ‘এত জল, ও কাজল চোখে…’ দেখার এক শীতঘুম অপেক্ষাও থাকে হাওরপারের মানুষের। জলকে ঘিরে দীর্ঘ একটা সময় কাটে তাদের। কত আচার, কত আয়োজন, কত অবসর। এ বাড়ির ঘাটে ও বাড়ির নৌকা ভেড়ে। এক টুকরা উঠান হয়ে ওঠে হু হু করা বাতাসে শরীর জুড়ানোর বৈঠকের পিঁড়ি। হঠাৎ দূর কোনো গ্রাম থেকে হাওরের বুক চিরে ছোট ডিঙিখানায় পাল উড়িয়ে বাপ-ভাইয়ের গাঁয়ে ফেরে, নাইওর আসে কোনো নারী।
এক শ্রাবণের (২৮ জুলাই) বিকেল তখন ঝিম ধরে আছে। ভ্যাপসা গরম। চামড়া মরিচজ্বলা তাপে পুড়ছে, ঘাম ঝরছে। বাতাসও চুপচাপ, গাছের পাতারা নড়লেও চোখে পড়ে না। স্তব্ধ হয়ে আছে। মানুষ, প্রাণবৈচিত্র্য একটু শীতল হাওয়া, একটু ছায়াকেই মনে করছে পরম পাওয়া। সড়কের পাশে এখানে-ওখানে হিজল-করচ, নানা রকম জলজ বুনো গাছের নিচে যেটুকু ছায়া। তার মধ্যেই কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে উদলা, আধা উদলা মানুষের জটলা। নারীরা বসে আছেন বাড়ির উঠানের ছায়ায়। শিশুরা সীমিত ডাঙায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।
এ রকম এক মুহূর্তে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরের বুক চিরে চলে যাওয়া রাজনগর-বালাগঞ্জ খেয়াঘাট সড়ক ধরে যতই হাওরের পেটে ঢুকছে সময়, ততই জল, ততই জলের ঘাস…। এ রকম জলের বুক কেটে এক কিশোর তার ডিঙি নাওখানি বেয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ছুটছে। নাওয়ে হয়তো ঘরের মানুষ, নয়তো পড়শি কেউ। কিছু পরপরই এ রকম ছোট ছোট নৌকার দেখা মেলে। সময়টা এ রকমই, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাওয়ার। পথঘাট তো ডুবেছে সেই কবে বৈশাখে, নয়তো জ্যৈষ্ঠে। কেউ নৌকা করে হাওর থেকে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে। কেউ জাল দিয়ে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। এক বর্ষায় কেন, সব কটি বর্ষাতেই হাওরের শরীরভরা এমন সব প্রাণ ছড়িয়ে থাকে।
জলবায়ুর মন ভার করা সময় এখন। প্রথার মতো প্রচলিত সব নিয়মকানুন যেন আর মানতে চাইছে না কেউ—না মেঘ, না বৃষ্টি। কখন যে ভারী বর্ষণে অস্থির হয়ে ওঠে সবকিছু। তখন রাস্তাঘাটই ডোবে না, উপচানো জলে কারও বাড়িঘরও ডুবে যায়। আবার অনেক দিন আকাশে মেঘ ভাসলেও বৃষ্টির দেখা নেই। তবু বর্ষা, ওটা তো আর দুই মাসের ঋতুতে আটকে থাকার কেউ না।
হাওরে এখানে-ওখানে করচের গাছ, হিজলের গাছ চুলখোলা নারীর মতো গলা ডুবিয়ে আছে। যেন তারা যেটুকু শীতল জল, তাতেই জুড়িয়ে নেয় শরীর। কারও কোমরসমান পানি, কারও গলাজড়ানো সুখ। হাওরের অনেকটা জুড়ে কচুরিপানার শাসন চলছে। ফাঁকে ফাঁকে জলের সিনায় ভেসে আছে ঝোপালো সবুজ ঘাস, ফুল ফোটানোর আনন্দ-অপেক্ষায় দিন কাটছে শাপলা-শালুকের। কাউয়াদীঘি হাওরের বুড়বুড়ি ছড়ার কাছে মাছ ধরছিলেন কয়েকজন জেলে। তাঁরাই বলেন, আর কিছুদিন পর দেখা যাবে হাওর আরেক রকম। ভাদ্রে, আশ্বিনে লাখো সাদা শাপলা ফুটবে জলে। যত দূর তাকানো যাবে, হাওয়ায় দোল খাওয়া ফুলগুলোকে মনে হবে সাদা সাদা ফুলকন্যারা নাচছে। কে তাকাল, কে তাকায়নি—এ নিয়ে কারোরই মন খারাপের কিছু নেই। কাউয়াদীঘির জলের শরীরে শরতে এ রকমই সময় আসে।
তখন বেলা পড়ে এসেছে। হালকা ছাই, বরফের মতো টুকরা–টাকরা মেঘে সূর্যের শেষ আলো পড়ছে। হাওর কাউয়াদীঘি তখন আরেক রঙের। কেউ বুঝি টুক করে আলতা-সিঁদুরে হালকা, গাঢ় পরত বুলিয়ে দিয়েছে মেঘে মেঘে। তার ছোপ পড়েছে বিস্তীর্ণ হাওরের জলে, জলজ ঘাসে। বুড়বুড়ি সেতুর ওপর তখন এক দল তরুণ ভিড়েছে হাওয়ার খোঁজে, তাদের মনেও হয়তো এই রঙের টান। হাওর তখন এক রাতের জন্য ডুবছে সন্ধ্যায়।