‘স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। হতদরিদ্র মা–বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। মনে মনে ঠিক করলাম বিদেশে যাব। টাকা আয় করে জমি কিনব, বাড়ি বানাব। মা–বাবাকে নিয়ে সুখ-শান্তিতে দিন কাটাব। কিন্তু সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে পঙ্গুত্ব নিয়ে দেশে ফিরেছি।’
এসব কথা স্বপ্না খাতুনের। তিনি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা এলাকার পূর্বপাড়া গ্রামের আমিনুর রহমানের মেয়ে।
১০ আগস্ট বেলা একটার দিকে আশাশুনির বুধহাটায় পূর্বপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্বপ্না তাঁর বাবার কাঁচা ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছেন। কথা বলতে পারলেও সে সোজা হয়ে বসতে পারছেন না। দুই চোখে দেখতে পারছেন না। তাঁকে ধরে তুলতে হচ্ছে। হাতসহ শরীরে বিভিন্ন অংশে দগদগে পোড়া ঘা।
এ অবস্থা কেমন করে হলো জানতে চাইলে স্বপ্না খাতুন জানান, ২০২২ সালের জুলাই মাসে পরিচয় হয় আশাশুনির উত্তর চাপড়া গ্রামের মারুফ সরদারের সঙ্গে। তাঁকে বিদেশে যাওয়ার কথা বললে তিনি সবকিছু ঠিক করে দেবেন বলে জানান। তাঁর কথামতো পাসপোর্ট করা হয়। মারুফ সরদারের সহযোগিতায় ঢাকার বনানী এলাকার একটি ট্রাভেলস এজেন্সির (জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান) মাধ্যমে ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর সৌদি আরবে যায় তিনি। সৌদি আরবে রিয়াদের আলহাদি এলাকায় সৌদি নাগরিক মাকসুদ আলমের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ পান তিনি। দেড় মাস যেতে না যেতেই গৃহকর্ত্রী নানা অজুহাতে তাঁর ওপর নির্যাতন করতে থাকেন। তাঁকে ঠিকমতো খেতে ও ঘুমাতে দেওয়া হতো না।
স্বপ্না আরও বলেন, মাকসুদ আলমের বাসায় কাজ করার সময় খাদিজা নামের এক বাংলাদেশে নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি তাঁর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন পারলারে কাজ দেবেন বলে। তাঁর কথামতো ওই বাড়ি থেকে পালানোর সময় রাস্তা থেকে পুলিশ তাঁকে আটক করে। তাঁর বাসার মালিক একজন আইনজীবী। তিনি তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার পর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। কারণে–অকারণে মালিক মাকসুদ আলম ও তাঁর স্ত্রী তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করতে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বপ্না খাতুনের হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়েছেন। মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত করায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
মা মাশুরা বেগম জানান, উড়োজাহাজের এক সহযাত্রীর মুঠোফোন পেয়ে ১৮ জুলাই তাঁর মেয়ে স্বপ্নাকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রহণ করেন তিনি। তিনি দেখেন তাঁর শরীরের দগদগে ঘাঁ। চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ওই অবস্থায় তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসে ২২ জুলাই সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করেন। সেখানে ১২ দিন চিকিৎসা করার পর ৩ আগস্ট হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। চিকিৎসা নিয়ে স্বপ্না বেঁচে আছেন বটে, তবে চোখে দেখতে পান না ও সোজা হয়ে বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারেন না।
মা আশুরা বেগম ও বাবা আমিনুর সরদার জানান, মেয়েকে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা করাতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। স্থানীয় বিভিন্ন সমিতি ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন তাঁদের আর সামর্থ্য নেই। তাঁরা তাঁর মেয়েকে যাঁরা বিদেশে পাঠিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি দাবি করেন। পাশাপাশি সৌদি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চান।
এ বিষয়ে জানতে ওই ট্রাভেলস এজেন্সির স্থানীয় এজেন্ট আশাশুনির উত্তর চাপড়া গ্রামের মারুফ সরদার মুঠোফোনে জানান, তিনি সৌদিতে যাওয়ার জন্য বনানীতে একটি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার পর স্বপ্নাই সবকিছু করেছেন। এর বেশি তিনি কিছু জানেন না।
এ বিষয়ে স্থানীয় বুধহাটা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর হক বলেন, নদীর পাশে সরকারি জমিতে বসবাস করেন স্বপ্না ও তাঁর মা–বাবা। তাঁরা খুবই দরিদ্র। সৌদি সরকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।