বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

সোফিয়া লোরেনের দেশে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪

আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ইটালি গিয়েছিল। তবে যে প্রথম গিয়েছিল সে হচ্ছে ওয়াহিদ সিনহা। পাতলা ছিপছিপে, মুখে সবসময় হাসি, ভাল ফুটবল খেলতো। ক্লাসে পরীক্ষায় অঙ্কে শূন্য পেতো অথচ ইতিহাসে একশয় একশ। অঙ্কে একশ পাবার গল্প অনেক শুনেছি তবে ইতিহাসে একশ! হাজারে কেন লাখে একজন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ও ইতিহাস গল্পের মতো বলতে পারতো। আমার এখনো মোগল সম্রাটদের ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রথমই মোগলাই-পরটা মনে পড়ে যায়। যাইহোক আজকের গল্পটা স্কুলের বন্ধু ওয়াহিদ সিনহাকে নিয়ে নয়। আজকের গল্পটা কলেজের বন্ধু তারেককে নিয়ে। তবে এই গল্পে ওয়াহিদের একটা ছোট্ট ভূমিকা আছে। হাড়িয়ে যাওয়া তারেককে কুড়ি বছর পর ওয়াহিদ খুঁজে দিয়েছিল।

কলেজ জীবনে অনেক বন্ধু বান্ধব থাকলেও তারেকের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল একটু কাছের। ও আর আমি দুজনেই একই মেয়ের সাথে প্রেম করতাম! আপনারা ভাবছেন একই মেয়েকে প্রেম করলে বন্ধুত্ব হয় কি করে? সিনেমার নিয়ম অনুযায়ী একজনের হওয়া উচিত ভিলেন আর অন্যজনের নায়ক। ভিলেন আর নায়কে বন্ধুত্ব হলে আর যাই হোক সে সিনেমা চলবেনা।
এর জন্যেই বলে জীবনটা সিনেমা নয়!

আমি যে সময়ের কথা লিখছি তখন ক্লাসে আজকের মত গাদা গাদা মেয়ে থাকতো-না। খুব বেশি হলে প্রতি ক্লাসে আট থেকে দশ জন। তাই ক্লাসের পঞ্চাশটি ছেলেকে ভাগাভাগি করে কাজ চালাতে হতো। আমি আর তারেক সে হিসেবে লাকি, কারণ আমরা যে মেয়েটিকে প্রেম করতাম আমাদের জানামতে আমরা দুজনেই ছিলাম তার প্রেম-প্রার্থী। আর কপালে কালো টিপ জাহানরা, যার ছোরা বসানো চোখের চাউনি, যে ক্লাসে বসে সাপের মতো কালো বিনুনিটা বুকের উপর টেনে আঙ্গুল দিয়ে জড়াত, তার প্রেমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ জন। সবচাইতে বেশি ছিল দীপালী সাহার। ওর ভাসা ভাসা চোখ ছিল স্বপ্নে ভরা। ঠোট সব সময় চিক্ চিক্ করতো, মনে হতো এইমাত্র কেউ চুমু খেয়েছে।

যাইহোক, আমাদের প্রেমিকাটির নাম ‘ব্লাকরোজ’ রেখেছিলো তারেক। আমি ডাকতাম ‘গোলাপি’ বলে। তবে এসব গোলাপকে যে নামেই ডাকো কাঁটার ভয় নেই বললেই চলে। যদিও ডাকাডাকির প্রসঙ্গ এখানে না আসাই উচিত। মেয়েটির সাথে সাহস করে আমরা কখনও কথা বলিনি। আমরা দুজনেই কবিতা লিখতাম। তবে সাবজেক্ট ঐ মেয়ে। তুমি কি শুনতে পাওনা আমার বুকের তবলার তা ধিন ধিন তা…। কার কবিতা ভাল হয়েছে এ নিয়ে আমাদের ঝগড়া হতো। অথচ যাকে নিয়ে কবিতা রচনা, সে কিন্তু কিছুই জানতোনা!

তারেক ছিল বিদেশে যাবার জন্য পাগল। তবে আরব জাতিয় দেশে নয়, ইউরোপ অথবা আমেরিকা। কোন ইন্টারন্যাশনাল পেন-ফ্রেন্ড পত্রিকায় ঠিকানা ছাপিয়েছিল, সেই সুবাদে বেশ কিছু বিদেশিনী মেয়ের সাথে ওর পত্র লেখালেখি চলতো। নীল-খামে হলুদ কাগজে ওর কাছে চিঠি আসতো স্বর্ণকেশী মেয়েদের। বেশ একটা স্বপ্নের মধ্যে জীবন কেটে যাচ্ছিল আমাদের। তারপর যথারীতি অনার্স পরীক্ষা শেষ হলো। একদিন তারেক হঠাৎ করে আমাদের বাসায় এসে হাজির বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ওকে। কিরে কি খবর? বলল খবর দুটো, একটা বড়, একটা ছোট।

বড় খবর হলো আমি ইটালি যাচ্ছি। এই বলে পকেট থেকে পাসপোর্ট বেড় করে আমাকে ইটালির ভিসা দেখালো। জিজ্ঞেস করলাম ছোট খবরটা কি? সে অন্য পকেট থেকে একটা খাম বেড় করলো। খামটা খুলে দেখি একটা বিয়ের কার্ড। কার বিয়ে ? আমি প্রশ্ন করলাম। তারেক মাথা নামিয়ে বলল, আমার। উনি এমাসের শেষে বিয়ে করছেন, এবং পরের মাসের শুরুতে ইটালি যাচ্ছেন। ব্যাটা একখান! বিয়ে করেই বৌকে রেখে বিদেশে যাচ্ছিস? আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করি। ও বলল, আব্বা এই শর্তেই বিদেশে যাবার খরচ দিতে রাজি হয়েছেন। ওর আব্বার দোষ দিয়ে লাভ নেই, যে ছেলের কাছে মাঝে মধ্যেই নীল খামে সোফিয়া লোরেনরা চিঠি লেখে তাকে বন্ধনহীন ছেড়ে দিতে কোন মা-বাবা চাইবে?

তারেকের বিয়েতে আমার একটাই দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছিল, সেটা হচ্ছে ওর বিয়ের একটা নেম-তন্ন পত্র ব্লাকরোজকে পৌঁছে দেওয়া। আমি দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ওর হাতে কার্ড তুলে দেবার সাহস আমার ছিলনা, আমি ওদের বাড়ির লেটার বক্সে কার্ডখানা ফেলে এসেছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে ব্লাকরোজ স্বামী এবং ছয় মাসের সন্তান নিয়ে সেই বিয়েতে হাজির হয়েছিল। তারেক আনন্দে আটখানা। আমাকে একটু দুরে টেেন নিয়ে প্রায় জড়িয়ে ধরলো, তুই বিশাল একটা কাজ করেছিস ভাই, আমি ভাবতেও পারিনি ও আসবে। পকেট থেকে একটা কাগজ বেড় করে বলল গত রাতে ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি! আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিয়ের আগের দিন তিনি হবু বৌকে ফেলে, তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন যার স্বামী এবং একটি সন্তান বর্তমান। আর বিয়ে করছেন ইটালি যাবে কেননা যেখানে অনেক সোফিয়া লোরেন থাকে! আমি তারেককে বললাম ভাই তুই এই বিয়ে করতে যাচ্ছিস কেন বলতে পারিস? ও হাসতে হাসতে বলল, আমার বিদেশ যাবার প্লেনের টিকিট!

বেচারি তারেকের বৌ টিউলিপ, সে তখন বেনারসি শাড়ি, সোনা গয়নায় নববধূ সাজে চোখে মুখে রাজ্যের স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে একটা ‘চন্দ্রমুখী’ হাসি হেসেছিল। ‘চন্দ্রমুখী’ হাসি হচ্ছে চোখ এবং মুখের একত্রে যে হাসি। হুমায়ুন আহমেদের নায়িকারা সাধারণত এধরনের হাসি হাসে। আমি ভাবছিলাম এই ফুলের কলির মত মেয়েটির আগামী কষ্টকর জীবনের কথা। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক!

এরপর যথারীতি তারেক বৌকে ফেলে ইটালি চলে গিয়েছিল। আমিও নানা টানাপোড়ন নিয়ে অন্য এক জীবনে প্রবেশ করেছিলাম। যে জীবনে কলেজের বন্ধুদের তেমন কোন ভূমিকা থাকেনা। ওরা তখন হয়ে যায় রোল-কল খাতার মত কতগুলো নাম মাত্র। এভাবে অনেক গুলো বছর কেটে গেল। জীবনের সায়াহ্নে এসে হঠাৎ হঠাৎ কারো কথা মনে পরে যায়। এই ফেস বুকের কল্যাণে দু চারজনকে খুঁজেও পেয়েছি। ওয়াহিদ সিনহাকে পেলাম সে এখন ইটালির রোমেই আছে। ওকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম তারেকের কথা। ও একগুচ্ছ তারেকের কথা বলল তবে- লম্বা, কোঁকড়ানো চুল, কার্ক ড-গ্লাসের মতো থুতনিতে টোল পরা আমার সহপ্রেমী তারেককে খুঁজে পেলাম না। সহপাঠী মেয়েদের ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায়না, ওনারা সারনেম বিয়ের পর কেন যে বদলায় বুঝি না! ব্লাকরোজকে পাইনি, দীপালী সাহাকেও খুঁজে পাইনি, খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল এখনো ওর ঠোট ভেজা ভেজা চিক চিক করে কিনা!

একদিন ওয়াহিদ সিনহাই আমাকে জানালো নাহপ্লিসে (Naples) টিউলিপ হাসান বলে একজন থাকেন ওর স্বামীর নাম তারেক! ফেসবুক সার্স করতেই বুঝলাম ঠিক জায়গায় পৌছেগেছি, প্রোফাইল পিকচারেই টিউলিপের সাথে তারেক। তারপর আমার সাথে যোগাযোগ হলো। তারেকের নিজের কোনো ফেসবুক পেজ নেই। তবে ফোনে, হোয়াটসএ্যাপ এ যোগাযোগ প্রায় নিয়মিত হতে লাগলো, গত কুড়ি বছরে জমে যাওয়া গল্প-তো অনেক ছিল! তারপর ইটালির অসংখ্য করোনা ভাইরাস আক্রমণের তালিকায় তারেকও নাম লেখালো।

এখানে বলেরাখি গত দুই বছর আগে সস্ত্রীক ইউরোপ বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই নাহপ্লিসে যাবার কোনো প্লান ছিলনা। রোম থেকে সিডনি ফিরে আসার কথা। সেই শহরটা রোমের দক্ষিণে আরাই তিন ঘণ্টার রাস্তা। তারেক এমন জোড় করলো যে রোম দেখা একদিন স্থগিত রেখে বাসে করে গিয়েছিলাম সেখানে। তবে সেখানে গিয়ে আপসোস হয়নি। তারেকই ওর গাড়িতে ঘুড়িয়ে দেখিয়ে ছিল সেই ঐতিহাসিক শহর পম্পে আর পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষতিকারক আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস। চার লক্ষ বছরের পুরানো হলে কি হবে, এখনো জীবন্ত। একটা রাতই ওদের ওখানে ছিলাম তারেকের স্ত্রী টিউলিপ আমাদের এতটা আপন করে নিয়েছিল যে ফেররার সময় চোখে জল ধরে রাখতে কষ্ট হয়েছিল। ওদের একটি মেয়ে। সারারাত গল্প করেছি। তারেক আগের মতই আছে। টিউলিপের হাসিটা তেমনই চন্দ্রমুখী। ওর মনটা ঐ হাসির চাইতেও সুন্দর। তারেকই জানালো দশ বছর আগে শেষ খবর পর্যন্ত ব্লাকরোজ দুটো বিয়ে করেছে। টিউলিপ বলল, ও দুটো বিয়ে করবে আগে জানলে-তো তোমরা দুজনে মিলেই বিয়ে করতে পারতে। আমরা সবাই হো হো করে হেসেছিলাম।

ইটালি সম্বন্ধে ভয়াবহ খবর যখন সবখানে তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমার ওয়াহিদ আর তারেকের কথা মনে হলো। জানলাম ওয়াহিদ ভাল আছে তবে তারেক ঠিক নেই। ওর স্ত্রী টিউলিপ বলল, তারেক এখন হাসপাতালে। মনটা খুবই বিষণ্ণ হলো। আমি রোজ খবর নিচ্ছিলাম। কেমন আছে তারেক? ঠিকনেই দাদা ওকে ইনকিউভেটরে দিয়েছে। টিউলিপ লিখেছে, আমকে কাছে যেতে দিচ্ছেনা। খুব কষ্ট পাচ্ছে দাদা অথচ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! আমি টিউলিপকে সান্ত্বনা দেই, একদম চিন্তা করোনা, দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।

সান্ত্বনা দেয়া সহজ, কিন্তু আপন জন চলে যাচ্ছে এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখা যে কি কঠিন তা শুধু ভুক্ত-ভুগিই জানেন। এর পর টিউলিপ খবর দিল, দাদা ও আমাকে চিনতে পারছে না। আমি ফোন করলাম, টিউলিপ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
টেলিফোনে মেসেজ দেখা প্রায় বন্ধ করে দিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি মর্মান্তিক খবরটা আসবে! টিভির পর্দায় ইটালির করোনার খবর আসলেই চোখ বন্ধ করে ফেলতাম। ঐ মৃতের সংখ্যায় তারেকও কি রয়েছে?

তারপর সেই আশ্চর্যজনক ফোনটা পেলাম। টিউলিপের গলা, আমি হ্যালো বলবার আগেই ও বলল, দাদা তারেক ভাল আছে, আগামী কাল ওকে বাসায় নিয়ে আসবো। একটা শান্তির নিঃশ্বাস আমার বুক থেকে নেমে এলো, আমি পরিষ্কার দেখছিলাম টিউলিপের মুখে সেই ‘চন্দ্রমুখী’ হাসি। একদম ঠিক কথা, ভালবাসা মৃত্যুর চাইতেও শক্তিশালী।তারেক বাসায় ফিরেছে। আমার সাথে ফোনে কথাও হয়েছে। তাই ঘটনাটা লিখলাম। শেষটা অন্যকিছু হলে এই গল্পটা লেখার মত বুকের পাটা আমার কখনো হতোনা।

আশীষ বাবলু

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com