শুনেছি কেয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে কেউ নাকি কারো দিকে তাকাবারও ফুরসত পাবে না। সবাই পেরেশান থাকবে নিজেকে নিয়ে। অনেকটা তেমনই অনুভব করলাম এবারের সেন্টমার্টিন ভ্রমণে। কক্সবাজার থেকে দারুচিনি দ্বীপে যাওয়া এবং ফেরা – এ যেন ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার এক জটিল প্যাকেজ।
সেদিন ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার। সূর্য ওঠার আগেই নুনিয়াছড়া জেটির কাছে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। চারটি জাহাজের মানুষ একটি মাঠে গাদাগাদি করে রয়েছেন। সেখানে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবারই জাহাজ ৭টায় ছাড়ার কথা। এখন কর্তৃপক্ষ বলছেন, জোয়ার এলে ছাড়বেন। কিন্তু কেন? জোয়ারের সময়সূচি কি হঠাৎ বদলে গেলো? তারা কি আগের রাতেই মেসেজ পাঠিয়ে জানাতে পারতেন না সবাইকে? জাহাজের টিকিট যদি অনলাইনে পাওয়া যায়, তবে সময়সূচির আপডেট কেন পাঠানো হলো না? প্রত্যেক যাত্রীর মুঠোফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল ইত্যাদি তথ্য কেন নেওয়া হলো তবে?
আমার মতো সকল ভুক্তভোগী যাত্রীর প্রশ্ন, কেন এই অনিয়ম? কেন যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে ফেলা হয়েছে জেটি ও জাহাজের পরিবেশ? আমি যে জাহাজে উঠেছিলাম, সেটাতে আমার মতো কয়েকশ মানুষ অন্য জাহাজের টিকিট নিয়ে উঠেছি (যাদের জাহাজ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে কোনো রকম খবর না দিয়ে)। আমরা উদ্বাস্তুর মতো কখনও ডেকে, কখনও বারান্দায়, কখনও বা অন্য কারো দয়ায় তাদের সিটে বসে ৭ ঘণ্টা ভ্রমণ করলাম। সিটে বসা নিয়ে কয়েকজন মারামারি করে ফেললেন। বাকিরা কেউ সে আগুনে হাওয়া দিলেন, কেউ বা জল ঢাললেন।
গোটা রিসোর্টজুড়ে মনোমুগ্ধকর আলোক সজ্জা। দোতলায় কাঠের রেস্টুরেন্ট, সেখানে ছাদ যেমন আছে, তেমনি চাঁদ আর নক্ষত্রখচিত খোলা আকাশের নিচে বসেও সপরিবার বা সবান্ধব ডিনার উপভোগ করার ব্যবস্থা আছে। বারবিকিউ আর গান উপভোগ করতে করতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেলো। (এখানে খাবার সার্ভ করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে, তাই ধৈর্য রাখতে হয় যথেষ্ট পরিমাণ)। এই রিসোর্টটা সৈকত সংলগ্ন।
প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিনের সুনাম বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কয়েক মাস পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন এই দ্বীপে ভ্রমণ। সে কারণেই হয়তো এবার পরিবেশ বেশ খানিকটা উন্নতি করেছে। আমি ২০০২, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এসেছিলাম এখানে। তাই পরিবর্তনটা ধরতে পারছি। তখন (২০০৭) আমি গ্রামীণফোনে কাজ করছিলাম, এখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসছিল, সেই প্রকল্প দেখতে এসেছিলাম।
মাত্র দু’মাসের জন্য খুলে এ বছর জানুয়ারির পর আবার বন্ধ হয়ে যাবে দ্বীপে ঢোকার দরজা। হয়তো তাই প্রতিদিন অন্তত হাজার দুয়েক পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এই প্রবালঘেরা সৈকতে। প্লাস্টিকের বর্জ্য তাই চোখে পড়লো যত্রতত্র। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী আসছে শিক্ষাসফরে। সাগর মানুষকে উদার হতে শেখায়, জানি না তারা সেটা শিখছে কি না। অন্তত জাহাজে বসার জায়গা নিয়ে মারামারির দৃশ্য দেখে আমি কিছুটা হতাশ। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ – সেটা তারা কতটা অনুধাবন করছেন, তাও বুঝতে পারছি না। সবার ফেলে যাওয়া বিরিয়ানি, চিপস আর জুসের অবশিষ্ট পাত্রাদি দেখে আমি কিছুটা শঙ্কিত।
আমাদের ফেরার দিন আমি অন্য জাহাজের টিকিট কেটে নিলাম (যেন আবারও উদ্বাস্তুর মতো ভ্রমণ করতে না হয়)। জাহাজে ওঠার যুদ্ধ আর জাহাজ থেকে নামার যুদ্ধ – দুটোই আমাদের ভ্রমণের সমস্ত আনন্দকে ম্লান করে দিলো। আমাদের জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারেনি আগে থেকে ভেড়ানো অন্য জাহাজের কারণে। কেন একটি জাহাজ তার যাত্রী নামিয়ে এখানেই রয়ে গেল, আর কেনই বা এক জাহাজ থেকে নামতে অন্য জাহাজের ভেতর দিয়ে খাড়া লোহার সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়, তার সদুত্তর কেউ দিতে পারলো না। বরং কয়েক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছানোর কারণে অনেকেই রাতে ঢাকায় ফেরার বাস মিস করলেন। আমরা যেহেতু আগে টিকিট কাটিনি, আমরা খুঁজে-পেতে একটা বাস ধরলাম, যেটা তখনই ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। রাত তখন একটা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। দুর্ভোগ আর উপভোগের অসম সমীকরণ মেলাতে মেলাতে বাসে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
তবু সাগরের নীল জল, সুবিশাল ঢেউ, প্রবালের সেই অপার সৌন্দর্য, আর রাতে সাগরের বুকে রূপালী জোছনার অপার্থিব মায়াবী আলোর অনুভূতি আমাদের হৃদয়ে রয়ে যাবে অক্ষয়, অব্যয় হয়ে।