শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩২ অপরাহ্ন

সুন্দরবনে বেপরোয়া শিকারি, থামছেই না হরিণ নিধন

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় হরিণশিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এবং পশ্চিম সুন্দরবনে সংঘবদ্ধ চক্র নির্বিচারে হরিণ শিকার করে চামড়া ও মাংস বিক্রি করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ও বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মচারীর সহায়তায় শিকারিরা নিয়মিত হরিণ শিকার করছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। কোস্ট গার্ড ও বনরক্ষীদের হাতে দু-চারটি হরিণ পাচারের ঘটনা ধরা পড়লেও শিকারিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

বাগেরহাটের মোংলার কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন সূত্রে জানা যায়, গত এক মাসে শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের ৪২৩ কেজি মাংস, হরিণ ধরার ৮০টি ফাঁদ এবং সাতজন শিকারিকে আটক করা হয়েছে। বন বিভাগ ও কোস্ট গার্ডের নিয়মিত অভিযানেও শিকারিদের তৎপরতা কমানো যাচ্ছে না।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১২ মার্চ পশ্চিম জোন সুন্দরবনের মরালক্ষ্মী খালসংলগ্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে কোস্ট গার্ড। এ সময় একটি নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে হরিণের ২৫ কেজি মাংস এবং হরিণ শিকারের ৮০টি ফাঁদসহ পাঁচ শিকারিকে আটক করা হয়। তাঁরা সবাই খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার বাসিন্দা। পরদিন ১৩ মার্চ রাতে সুন্দরবনসংলগ্ন নলিয়ানের বালুর মাঠ এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ইয়াসিন গাজী নামের এক ব্যক্তিকে হরিণের ২৮ কেজি মাংসসহ আটক করা হয়।

১৬ মার্চ রাতে বনের কয়রা, কৈখালী ও হাড়বাড়িয়া স্টেশনের কয়রা, শ্যামনগর এবং মোংলার জয়মনিরঘোল এলাকায় পৃথক তিনটি অভিযান চালায় কোস্ট গার্ড। এসব অভিযানে হরিণের ২০৫ কেজি মাংস, দুটি মাথা, দুটি চামড়াসহ এক শিকারিকে আটক করা হয়। আটক বাবু আলম (২৭) সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা।

কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সিয়াম উল হক বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বন্য প্রাণী শিকার ও পাচার রোধে নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে।

৮ এপ্রিল সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান ঠাকুরবাড়ি এলাকা থেকে হরিণের ১১০ কেজি মাংসসহ আরিফুল শেখ নামের একজনকে আটক করে কোস্ট গার্ড। এরপর ১১ এপ্রিল মোংলার জয়মনিরঘোল এলাকায় অভিযান চালিয়ে হরিণের একটি চামড়া ও ২৪ কেজি মাংস উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল মোংলার জয়মনিরঘোল এলাকায় একটি বস্তা থেকে ৩১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে কোস্ট গার্ড।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা জানান, হরিণ শিকার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। গভীর বনে ফাঁদ পেতে হরিণ ধরছে শিকারিরা। শিকারিদের বিরুদ্ধে কথা বললে হুমকি দেওয়া হয়। কাঁকড়াশিকারিরাও টোপ তৈরি করতে হরিণের মাংস ব্যবহার করে।

সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, হরিণশিকারিদের ধরতে বন বিভাগের নিয়মিত টহল অব্যাহত আছে। টহলে শিকারিরা আটকও হচ্ছে। শিকারিদের অপতৎপরতা ঠেকাতে যে আইন আছে, তা আরও কঠোর করতে সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, মোরেলগঞ্জের জিউধরা, পাথরঘাটার চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া এলাকার শিকারিরা জেলে বেশে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণ শিকার করে লোকালয়ে নিয়ে আসে। রামপাল ও সাতক্ষীরা এলাকার জেলেরা কাঁকড়াশিকারের টোপ বানাতে নিয়মিত হরিণ শিকার করছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের সুপতি, দুবলা, কটকা, কচিখালী, বাদামতলা, চান্দেশ্বর, টিয়ারচর, কোকিলমুনি, আন্ধারমানিকসহ গভীর বনের সুবিধাজনক স্থানে নায়লনের ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করা হয়। প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। টাকা বেশি পেলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গিয়েও মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, রাসমেলাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকারের ঘটনা ঘটে। তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে শিকারিরা বনে ঢুকে নির্বিচারে হরিণ শিকার করে।

সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, হরিণ শিকার বন্ধে কোস্ট গার্ডের কিছু অভিযান দৃশ্যমান হলেও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে সুন্দরবনে এই অপতৎপরতা বেড়েই চলেছে। বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হরিণশিকারিদের জন্য কঠোর আইনও করতে হবে।

হরিণ পাচারের রুট

শরণখোলা প্রতিনিধি খোঁজ নিয়ে জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী, চান্দেশ্বর, ডিমের চর এবং শরণখোলা উপজেলার পানির ঘাট ও সোনাতলা এলাকা হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চর দোয়ানি, কাঁঠালতলী, জ্ঞানপাড়া ও পদ্মা স্লুইস এলাকার একটি সংঘবদ্ধ চক্র রাতের আঁধারে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। সুন্দরবন থেকে শিকার করে এনে শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হরিণের মাংস পাচার করে চক্রটি।

এ বিষয়ে বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করীম বলেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকার প্রতিরোধে বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। লোকবলসংকটের কারণে কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে বনরক্ষীদের হাতে মাঝেমধ্যেই হরিণশিকারিরা আটক হচ্ছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com