ধসের মুখে পড়েছে প্রযুক্তি খাতের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন স্টার্টআপ এই ব্যাংক থেকে ঝড়ের গতিতে অর্থ তুলে নেওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর বিশ্বের অন্য প্রান্তের লোকজন আক্ষরিক অর্থেই ঘুম থেকে উঠে এই খবর পেয়েছেন।
গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই পতন।
“আমাদের নগদ সম্পদের ৯০ শতাংশই ছিল ‘এসভিবি’তে।” – বলেন ২৮ বছর বয়সী স্যাম ফ্রাংকলিন। লন্ডনভিত্তিক এই প্রযুক্তি সিইও’র কোম্পানি ‘ওট্টা’ অন্য কোম্পানির জন্য লোক নিয়োগের কাজটি করে। তাদের বিশেষত্ব হলো নিয়োগদাতার জন্য মেধাবী প্রযুক্তিকর্মী খুঁজে বের করা।
এখন মাস শেষে কীভাবে নিজের কর্মীদের বেতন দেবেন, সেই চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে। পেশাদারদের সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘লাইফ অ্যাডমিন’ পড়তেন তিনি। এখন সেই কাজে দেওয়ার মতো বিন্দুমাত্র সময় নেই তার।
হংকংয়ের পরিধানযোগ্য সামগ্রী বিক্রেতা কোম্পানি ‘সাউন্ডব্রেনারের’ সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরিয়ান সিমেনডিংগার গত সপ্তাহে ‘এসভিবি ফিনান্সিয়াল গ্রুপ’-এ চলমান আতংকের শুরুর দিকটা সময়মতো জানতে না পারলেও পরবর্তীতে দ্রুতই এই সম্পর্কে জানতে পারেন।
“আমার প্রতিক্রিয়া অনেকটা এমন ছিল। মানে কী? তামাশা না কি? আমার ব্যাংক? আসলেই!” –বলেন তিনি।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে লগ ইন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন তিনি। অথচ ওটা ছিল ব্যাংকের নিয়মিত লেনদেনের সময়।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ধসের বিশাল প্রভাব মাত্রই জানা যাচ্ছে। তবে, একটি বিষয় পরিষ্কার। তা হলো, বিভিন্ন টেক স্টার্টআপ যতই একে অন্যের থেকে দূরে থাকুক না কেন, এগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে অনেকেই নিজেদের দৈনিক কার্যক্রমের জন্য কোনো মাঝারি আকারের একটি ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সহকর্মীদের নেতৃত্ব অনুসরণ করে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্টার্টআপও ব্যাংকটি থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংকের খেতাব পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানের আলাদা পরিচিতি আছে এর সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের সম্পর্কের কারণে। এখানে বিশেষ আর্থিক সেবা পেতো বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি।
‘মার্কিন প্রতিষ্ঠাতারা সতর্ক’
এই ধসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক থেকে কোটির বেশি ডলার সরানোর চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ভিত্তিক ইভি চার্জিং স্টার্টআপ ‘ইলেক্ট্রা এরা’র প্রতিষ্ঠাতা কুইনসি লি।
অতিরিক্ত ট্রাফিকিংয়ের প্রভাবে এর ওয়েবসাইটও ঠিক মতো চলছিল না। এক গ্রাহক সেবা এজেন্ট তাকে ফোনে বলেন, অনেক বেশি মানুষ অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করায় লেনদেন সম্পন্ন হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। সোমবার বিকেলে তিনি নিজের অর্থ তুলে নিতে সফল হন ও বিকল্প ব্যাংক খুঁজতে থাকেন।
এসভিবি’র যুক্তরাষ্ট্র অংশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ রুদ্ধদ্বার আলোচনা চলার পর নিয়ন্ত্রকরা জানান, এক জরুরী তহবিলের সহায়তায় ব্যাংকের গ্রাহকরা নিজেদের জমা করা অর্থে প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন।
ব্রিটেনের ‘চ্যান্সেলর অফ দ্য এক্সচেকার’ জেরেমি হান্ট বলেন, এসবিভি’র যুক্তরাজ্য অংশ এইচএসবিসি’র কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে দেশটির সরকার ও ‘ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড’। এই পদক্ষেপে ট্যাক্স পরিশোধের সুবিধা ছাড়া সকল জমা দেওয়া অর্থ সুরক্ষিত থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।
‘ইউরোপও সতর্ক’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছে, এই ব্লকে ব্যাংকটির উপস্থিতি ‘খুবই সীমিত’। আর জার্মান স্টার্টআপস অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিচালক ক্রিস্তফ স্ট্রেসিং সতর্কতামূলক আশার বাণী শোনান, বিভিন্ন স্থানীয় কোম্পানি সহজেই এটি থেকে বের হতে পারবে।
ব্যাংকিং শিল্পের এই শঙ্কার প্রভাব পড়েছে ইউরোপীয় শেয়ারবাজারেও। এমনকি যেসব স্টার্টআপ এসভিবি’র সঙ্গে লেনদেন করেনি, তারাও ভুগছে।
“এসভিবি এই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের সঙ্গে কতোটা ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত, সেটি বোঝা কঠিন।” –বলেন লন্ডন ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা স্টার্টআপ ‘লিফটেড’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী রেচেল ক্রুক। সপ্তাহান্তে তিনি বিনিয়োগকারীদের নিশ্চিত করেছেন, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা সরবরাহকারতরা এ ঘটনার শিকার হবেন না। এর আগে কোম্পানির নির্বাহীরা ভয় পেয়েছিলেন যে, তাদের কোম্পানির কোনো মালিকের অর্থ এসভিবি’র সঙ্গে সংযুক্ত কি না।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকটির সঙ্গে লেনদেন করা ইউক্রেইনভিত্তিক স্টার্ট আপ ‘লেমন ডটআইও’র প্রধান নির্বাহী অ্যালেক্সান্ডর ভলদারস্কি রয়টার্সকে বলেন, গেল বৃহস্পতিবার অঞ্চলটির অন্যান্য উদ্যোক্তার সঙ্গে এই ধস নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।
“শুক্রবার সকাল থেকে আমরা এখানকার অর্থ অন্যত্র পাঠানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই হয়নি এখনও।” –বলেন তিনি।
“আমরা ভাগ্যবান। কারণ, কেবল দুইদিন আগেই বিভিন্ন নির্মাতা ও প্রকৌশলীকে অর্থ পরিশোধ করেছি।”