সিরিয়ার সরকারী নাম “সিরিয়ান আরব রিপাবলিক”। সিরিয়া ভূমধ্য সাগরের পূর্ব দিকে আরব উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত একটি দেশ। এর উত্তরে তুর্কি ও লেবানন, পশ্চিমে ইসরায়েল, পূর্বে ইরাক এবং দক্ষিনে জর্ডান সীমান্ত অবস্থিত।
জাতিগত দ্বন্দ্ব আর আন্তর্জাতিক কূটচালে পড়ে একটি দেশ কীভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তা সিরিয়ার অবস্থা না দেখলে বোঝা যায় না। প্রায় আট বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেনের পথ ধরে সিরিয়ায় রক্ত ঝরছে। এ যেন রক্তের স্রোতোধারা, না থেমে বাড়ছে দিন দিন। বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের আহাজারিতে বিশ্ব মানবাধিকার যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
১। বর্তমান সিরিয়া যে অঞ্চল জুড়ে গঠিত তা সর্বপ্রথম খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে নব্য অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে একীভূত হয়।
১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর সিরিয়ার সরকার জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করে। এর ফলে ফ্রান্সের জারিকৃত ও লিগ অফ নেশনস কর্তৃক আরোপিত “সিরিয়ার জনগণকে প্রশাসনিক উপদেশ এবং সহযোগিতা দেয়ার” আদেশনামা রদ হয়ে যায়। সিরিয়া প্রথমবারের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিরিয়া মিশরের সাথে একীভূত হয় এবং সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠন করে। উভয় দেশে গণভোটের মাধ্যমে প্রস্তাবটি সমর্থিত হয়। তবে ১৯৬১ সালে সিরিয়া এই প্রজাতন্ত্র থেকে আলাদা হয়ে আসে এবং তার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে।
সিরিয়া ১৯৬৩ সাল থেকে বা’থ পার্টি দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। এই দলটি ১৯৭০ সাল থেকে শুধুমাত্র আসাদ পরিবার দ্বারা পরিচালিত। তবে বর্তমানে সিরিয়া সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের কারনে বিভিন্ন বিরোধী দলের অধীনে বিভক্ত।
২। ১ লাখ ৮৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৮৫ লাখ মানুষের বসবাস। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ৮৭ তম বৃহত্তম দেশ।
৩। দেশটির সরকারী ভাষা আরবি।
৪। সিরিয়ার নাগরিকদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ সুন্নি মুসলিম। এর মধ্যে কুর্দি ৯ শতাংশ ও বাকিরা আরবীয়। এবং শতকরা ১০ ভাগ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী।
৫। দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। দামেস্ক অবিচ্ছিন্ন ভাবে মানব বসবাসের ইতিহাস সমৃদ্ধ বিশ্বের সুপ্রাচীন নগরী হিসেবে পরিচিত। খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ সাল থেকে এই নগরীর ইতিহাস সমৃদ্ধ।
সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু দামেস্কের নাম উঠে আসবে না এটা কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। প্রায় দশ হাজার বছর ধরে মানুষের বসতির চিহ্ন মেলে এখানে। তাই অনেকেই দাবি করেন দামেস্কই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। তবে এখনও সেই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলেনি। সেই আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, পম্পেই থেকে শুরু করে খালেদ ইবনে ওয়ালিদের মত অসাধারণ সব বিজেতার পদধূলিতে যুগ যুগ ধরে ধন্য দামেস্কের মাটি।
৬। সিরিয়ার পতাকাতে দুটি তারা মিশর ও সিরিয়ার মধ্যে পূর্ববর্তী ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করে।
৭। দেশটির বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়া আর্দ্র ভূমধ্য উপকূল থেকে শুরু করে শুষ্ক মরুভূমিতে পরিবর্তিত হয়। দেশটির বেশিরভাগ অংশ শুষ্ক মালভূমি তবে ভূমধ্যসাগর সীমান্তের উত্তর-পশ্চিম অংশ মোটামুটি সবুজ।
৮। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক বিশ্বব্যাপী তার ইস্পাতের জন্য বিখ্যাত। এখানকার ইস্পাতের অনন্য গঠন এটিকে বিশ্বব্যাপী এক লোভনীয় বস্তুতে পরিণত করেছে। দামাস্কাস ইস্পাত বেশিরভাগই ছুরি, তলোয়ার এবং অন্যান্য এমন সব অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।
৯। পৃথিবীতে প্রথম খুনের ঘটনা কোথায় ঘটেছিল জানেন? এটা ছিল সিরিয়া! সূত্র মতে, আদম ও ইভের পুত্র কায়িন দামেস্কের নিকটবর্তী মাউন্ট কাসাউউনে তাঁর ভাই আবেলকে হত্যা করেছিলেন।
১০। সিরিয়া জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১১। সিরিয়ার বৃহত্তম লেক, আসাদ লেক, আসলে মানুষের দ্বারা তৈরি এবং এটি ১৯৬৮ সাল থেকে থেকে বিদ্যমান।
১২। শাউটিং ভ্যালি মোট চারটি দেশের মিলনস্থলঃ সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান এবং ইসরাইল। এটি একটি “ইকো পয়েন্ট” এবং এই ৪ দেশের লোকেরা প্রায়ই এখানে তাদের আত্মীয়দের সাথে দেখা করার জন্য মিলিত হয়।
১৩। ইসলামের চতুর্থ পবিত্রতম স্থান হলো দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। এটি একইসাথে রাজা সালাদিনের সমাধিসৌধ।
১৪। ২০০১ সালের মে মাসে, পোপ দ্বিতীয় জন পল সিরিয়ার দামেস্ক শহরের উমাইয়া মসজিদ পরিদর্শন করেন এবং তিনিই মসজিদে যাওয়া প্রথম পোপ।
১৫। দেশটিতে চলমান রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের এক পক্ষে রয়েছে সিরিয়ায় ৪০ বছর ধরে শাসনকারী আলওয়াইটস গোত্রের নেতৃত্বে বাথ পার্টি এবং তাদের সমমনারা। অন্যদিকে আছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা, যাদের মধ্যে আছে সিরিয়ার ৬০ শতাংশ সুন্নি জনগোষ্ঠী এবং তাদের সমমনারা।
১৬। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়া, ইরান সব বিষয়ে বাশার আল-আসাদ সরকারের পক্ষে থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা বিপক্ষে। জাতিসংঘে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সব প্রস্তাবের ভেটো দিয়েছে এরা। আর আরব লিগ শুরু থেকেই দোটানা অবস্থায়।
১৭। ২০১৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট বা আইএস সিরিয়ায় পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসে। একের পর এক হামলায় জেরবার করে ফেলে সিরিয়ার সরকারকে।
১৮। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি সময় ধরে চলছে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সিরিয়ার সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু থেকেই চলছে।
১৯। দীর্ঘ সময় ধরা চলা যুদ্ধের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে চলে যায়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার হিসেবে আনুমানিক ১ কোটি মানুষ সিরিয়া ছেড়ে গেছে।
২০। লেবানন, জার্মানি, ইরান ও তুরস্ক সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরও ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য। তবে ২০১৭ সালে ৬৬ হাজার শরণার্থী আবার নিজভূমে ফিরে আসে।
২১। যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উৎপাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ, সেই দেশ এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উৎপাদন হতো দৈনিক ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল, এখন হয় মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উৎপাদনে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যেই সিরিয়ার মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ১ ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ সিরিয়ান পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় ১ ডলার। জনসংখ্যার বড় অংশ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক শতাংশেরও কম ছিল।
২২। সিরিয়ার সরকারী মুদ্রা সিরিয়ান পাউন্ড।
২৩। দেশটির মোট জিডিপি মাত্র ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ১৫০০ মার্কিন ডলার।
২৪। সিরিয়ার ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৯৬৩।