সারা বিশ্বের লোকরা সিডনিকে নানা রকম নামে আখ্যায়িত করে। সুইট সিডনি, হানি সিডনি, ফানি সিডনি বা আরো কতো রকম নামে। আমি এর নামকরণ করেছি ‘সিটি অব সী গাল’। কারণ সিডনিকে ঘিরে রেখেছে সাগর। আর শহরটির এখানে সেখানে উড়াউড়ি করে সী গাল। অন্য পাখীতো আছেই। সিডনি বন্দর ও পোতাশ্রয় হচ্ছে প্রাকৃতিক। শহরের বিভিন্ন অংশে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশ ডালপালা মেলেছে। ফলে শহরের সর্বত্র প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা মেলে। সাগরের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে কমপক্ষে ৩০ টির মতো সৈকত রয়েছে। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য কে সাজিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা যে অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতেই পুরো পৃথিবীর মানুষ ছুটে আসে সিডনিতে। যেমন এসেছি আমি
পৃথিবীর বহু দেশে বহু সাগর মহাসাগরের সাথে আমার দেখাহয়েছে। ছুটে গিয়েছি সে সব বীচে। কিন্তু এই প্রশান্ত মহাসাগরকে আমি একটা অন্যরকম সমীহ করি। এর নীল জল বা অন্য রকম ঢেউ ই শুধু এর কারণ নয়। এই সমুদ্রতীর পৃথিবীর মোট স্থলভূমিকে ঢেকে দিতে পারে। যার অতল গহবরে ডুবে যেতে পারে মাউন্ট এভারেস্ট। তাছাড়া প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগে প্রাচীন পৃথিবীতে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে এক মহাদেশের অবস্থান ছিল। যার নাম ছিলো আটলান্টিস। আয়তনে এশিয়া মাইনর ও লিবিয়ার মিলিত আয়তনের চেয়েও বড় ছিল মহাদেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত, সভ্য আর ক্ষমতাশালী এক জাতির বসবাস ছিল আটলান্টিসে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল মহাদেশটি। শোনা যায়, প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনী থাকার কারণে আটলান্টিসের শাসকেরা বর্তমানের ইউরোপ আর আফ্রিকা পর্যন্ত তাঁদের শাসনক্ষমতা বিস্তৃত করেছিলেন। হঠাৎ এক ভুমিকম্পে দ্বীপটি তলিয়ে যায় আটলান্টিকের গর্ভে। আটলান্টিস সমুদ্রগর্ভে ডুবে যাওয়ার কিছু ভূ-প্রাকৃতিক প্রমাণও পাওয়া যায়। কারণ, গড়পড়তা প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব আগে একটি বড় ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে একটি দ্বীপের অর্ধেক সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার প্রমাণ আছে। এ প্রমাণ হাতে নিয়ে গবেষকেরা হারানো আটলান্টিসের খোঁজে চষে ফেলেছেন আটলান্টিক মহাসাগর। তবে সবই বৃথা। এখন পর্যন্ত এর টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবু বিজ্ঞানীরা হাল না ছেড়ে এখনো সাগরতলে আটলান্টিস খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের দৃঢ় আশা, হারানো আটলান্টিস একদিন না একদিন খুঁজে পাওয়া যাবেই যাবে।
তাই একে সমীহ না করলে কি চলে।
আজ একটু আগেই নাস্তা শেষ করে লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম গাইডের জন্য। বেশ সময় হাতে আছে। রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে পারতাম। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যদি ঘুমিয়ে পাড়ি। কারণ ক্রমাগত জার্নিতে শরীরটা বেশ টায়ার্ড। তাই রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে রিস্কটা নিতে মন চাইছিলনা।
আজ কয়েকদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে ঘুরে দেখে বার বার মনে হচ্ছিলো সব গুলো শহরই যেন বেশী বেশী সাজানো। সব কিছু যেন ঝকঝকে ছকছকে। শহরগুলো প্ল্যান করে তৈরি। বৃস্টি হচ্ছে, রাস্তায় কাদা নেই। বৃস্টির পর যেন আরো উজ্জল মনে হয় শহর। উইন্টারে প্রচুর শীত পড়ে অথচ স্নো পরে কম। বড় বড় সিটি ছাড়া হাই রাইজ ভবন খুব কম। পাহাড়ি এলাকা বলে এই শহরের পথঘাট বেশ উঁচু নীচু। শহরের মানুষের মাঝে রয়েছে এক অদ্ভুত শৃঙ্খলাবোধ। রয়েছে মার্জিত আচরণ আর একে অপরকে সহযোগিতা করার প্রবণতা। মেলবোর্নে আমার এক বন্ধু বলেছিলো অস্ট্রেলিয়ায় মাথা পিছু আয় বেশী। তবে দেশটি খুবই এক্সপেন্সিভ। তিনি মজা করে বলেছিলেন- সিডনি গেলে কিডনি বন্ধক রাখতে হয়। অর্থাৎ সারা বিশ্বের মধ্যে খরচের শহর সিডনি। টোকিও বা সিঙ্গাপুরের পরেই এর স্থান। এই কয়েকদিন সিডনি ঘুরতে গিয়ে নিজেই তার প্রমান পেয়েছি।
কাঁটায় কাঁটায় ৮ টায় এসে গাইড আমাদের তুলে নিলো। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য মাদাম তুসোর যাদুঘর। মাদাম তুশোর মূল জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তবে অন্যান্য দেশের মত সিডনিতেও এর একটি শাখা রয়েছে। আর এই জাদুঘরটিও কম আকর্ষণীয় নয়। মিউজিয়ামে ঢুকতেই চোখে পড়ে অস্ট্রেলিয়া নামের সুন্দর দেশটির আবিস্কারক ক্যাপ্টেন কুকের মোমের মুর্তি। পুরো কক্ষ জুড়ে জাহাজের মোটা দড়ি পাল ইত্যাদি। গাইড জানালো মাদাম তুশোর জাদুঘরের পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কিছু সিডনির জাদুঘরেও দেখা যায়। খেলাধূলা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতের অনেক বিখ্যাত বিষয়ের সঙ্গে এসব বিষয়ের পৃথিবী বিখ্যাত তারকাদেরও এখানে দেখা যায়। এখানে যেমন রয়েছে গান্ধীর বিখ্যাত মোমের মূর্তির সঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, অসামান্য চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক তেমনি চোখ ফেরানো যায়না এমন সুন্দরী ও চলচ্চিত্র তারকা মেরিলিন মনেরো। কিন্তু মোমের এ জাদুঘরটি অষ্ট্রেলীয় বৈশিষ্টেও উজ্জ্বল। প্রথমেই রাজনীতির কথা বলা যায়। দু’জন ব্যক্তিত্বের কথা বিশেষভাবে প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার। এদের মধ্যে প্রথম আবার স্যার হেনরি পার্কস। অষ্ট্রেলীয় রাজনীতিতে তাঁকে প্রায়ই এই ফেডারেশনের স্থপতি বলা হয়।
তুশোর জাদুঘরে অন্তর্ভুক্ত আরেকজন রাজনীতিবিদ হচ্ছেন বব হবক। তিনি ছিলেন লেবার দলের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালরে আইন ও শ্রম বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেন। তুশোর যাদুঘর দেখে বের হলে গাইড ঘোষণা দিলো আমাদের এখনকার গন্তব্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা। অন্য কয়েকটা হোটেল থেকেও কয়েকজন যাত্রী তুললো গাইড। তারপর রওয়ানা দিলো সিডনির উদ্দেশ্যে।
সিডনি থেকে ক্যানবেরার রাস্তাটা চোখে পড়ার মত। একেবারে সোঝা। আঁকাবাঁকা নয়। রাস্তায় একবার চা খাওয়ার বিরতি। তারপর সোঝা ক্যানবেরা। ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর।
লেখক: হাবিব রহমান: