২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ১ লাখ ৩২ হাজার ২২৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এসব ছাপানো টাকাও লুটপাট করার অভিযোগ আছে।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ১ লাখ ৩২ হাজার ২২৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এসব ছাপানো টাকাও লুটপাট করার অভিযোগ আছে।
তবে ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগে ছাপানো টাকায় ঋণের স্থিতি ছিল খুবই কম। এরশাদ সরকার টাকা ছাপিয়ে সরকার পরিচালনা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে বেশি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমলেও ছাপানো টাকায় ঋণের স্থিতি তেমন বাড়েনি। ১৯৯৬ সাল-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যয়নির্বাহে বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা বাড়িয়েছে। ওই সময়ে প্রথমবারের মতো ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাজেটে ঘোষণা করা হয়। তখন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
এর আগে কোনো সরকার এমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করত না। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছরেই বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়ার কোনো লক্ষ্যমাত্রা এখন পর্যন্ত কোনো সরকার ঘোষণা দিয়ে নির্ধারণ করছে না। অথচ বেপরোয়াভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিদায়ি সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। তারপরও ঋণ নেওয়া বন্ধ করেনি। কোনো কোনো বছর বেশি ঋণ নিয়েছে। কোনো বছর নতুন ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করেছে কিছুটা। তবে গড় হিসাবে ঋণ নিয়েছে বেশি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। ওই সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এটাই ছিল সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ। বৈশ্বিক মন্দার কারণে সরকারের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। এছাড়া ওই সময়ে ব্যাংকগুলোয়ও ডলার সংকটের কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয়। যে কারণে ব্যাংক থেকেও বেশি ঋণ নিতে পারছিল না। ফলে ওই সময়ে ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছিল করনোর সংক্রমণের সময়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। মূলত ওই তিন বছর রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার বেশি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ওই তিন বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪১২ কোটি টাকা, যা বর্তমান স্থিতির চেয়ে বেশি। কিছু ঋণ শোধ করায় ঋণের স্থিতি কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করার ফলে ২০২১ সাল থেকেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। ওই বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়ায়। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কারণে বিশেষ করে স্বল্প-আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে তাদের আয় কমেছে, এর বিপরীতে বেড়েছে খরচ। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চাপ বেড়েছে।
তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। ওই বছরে সরকার আগের নেওয়া ঋণের মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এতে ঋণের স্থিতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু গত জুলাইয়ে আবার ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ঋণ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। এতে স্থিতি কিছুটা বেড়েছে। আগস্টের শুরু থেকেও ঋণ নিয়েছে। এর বাইরে লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ধার দেওয়া হয়েছে। এগুলোও বাজারে এসে টাকার প্রবাহ বাড়িয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
এর আগে এ সরকারের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কম ছিল। ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রথম দেড় বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। বরং আগের নেওয়া ঋণ থেকে ৩ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করে। ২০১১ সালের জুনে আবার ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকায়। ওই বছরে সরকার নতুন ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালের জুনে ঋণের স্থিতি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৩১২ কোটি টাকায়। ওই বছরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নিয়েছে ৫ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের জুনে ঋণের স্থিতি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকায়।
ওই বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন কোনো ঋণ না নিয়ে বরং আগের ঋণ শোধ করেছে ৬ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জুনে এসে সরকারের ঋণের স্থিতি আরও কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকায়। ওই বছরে সরকার আগের ঋণ থেকে ১৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা শোধ করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
২০১৫ সালের জুনে ঋণের স্থিতি আরও কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৩১ কোটি টাকায়। ওই বছরেও নতুন ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ থেকে ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা পরিশোধ করে। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সরকার আবার ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ওই বছরে ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায়। ওই বছরে সরকার নতুন ঋণ গ্রহণ করে ১০ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ঋণ স্থিতি আবার কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকায়। ওই বছরে সরকার নতুন ঋণ গ্রহণ না করে আগের ঋণ শোধ করে ৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এরপর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সরকার আর কোনো ঋণ শোধ করেনি। বরং মাত্রাতিরিক্ত হারে নতুন ঋণ নিয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা এবং সরকারের বড় প্রকল্পের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বহুমুখী ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
২০১৮ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকায়। ওই বছরে সরকার নতুন ঋণ গ্রহণ করে ৭ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। ওই বছর নতুন ঋণ গ্রহণ করে ১০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ওই বছর সরকার ১৮ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা নতুন ঋণ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ওই বছরের মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। এর বিপরীতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
সূত্র : যুগান্তর