ভোর থেকেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। হালকা কুয়াশার আবরণ চারপাশে। পাহাড়চেরা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে ছুটে চলে আমাদের বাসটি। আঁকাবাঁকা সবুজে ঘেরা পথ। সকাল ঠিক আট’টা। সুপারভাইজার চেঁচিয়ে ডাকে, ‘এক নম্বর ঘাট’। এই ঘাটটি দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত টেকনাফে। সেখান থেকেই জাহাজটি ছেড়ে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে।
চার বন্ধু মিলে রওনা হয়েছি নারিকেল-জিঞ্জিরা খ্যাত সেন্টমার্টিন দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য দেখব বলে। আমি, জুয়েল, মৃদুল আর অরণ্য। নাফ নদীতে ভাসছে এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি। জনপ্রতি এক হাজার টাকায় আসা-যাওয়ার টিকিট নিয়ে উঠে বসি একেবারে ওপেন ডেস্কে। খানিক বাদেই টান পড়ে পেটে। পাউরুটি আর বাংলা কলায় টপাটপ সেরে নিই নাস্তার পর্বটি।
হুইসেল বাজিয়ে সকাল সাড়ে ন’টায় যাত্রা শুরু করে জাহাজটি। পাশের ঘাট থেকে ছাড়ে আরও দুটো জাহাজ। নাম দেখলাম কেয়ারী সিন্দাবাদ ও ঈগল-২ । সামনেই বঙ্গোপসাগর। টেকনাফের সবুজ পাহাড় আর নাফ নদী পেরিয়ে জাহাজগুলো এগিয়ে চলে সেদিকটায়। সমুদ্রের স্রোতে আমাদের জাহাজটি মাঝে মধ্যেই দুলে ওঠে। ভয়ে অনেক যাত্রী একেবারে জড়সড়। অনেকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে তার প্রিয়তমার হাতটি। অনেককেই দেখা গেল চোখ বুজে আছে। একদল যুবককে দেখলাম এরই মধ্যে দল বেঁধে গান গাইছে। ঢেউয়ের দোলায় তাদের আনন্দ যেন আরও বেড়ে যায়।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসে থাকার পর চোখের সামনে আচমকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বন্ধু জুয়েল উৎসাহ নিয়ে দেখায় দ্বীপটি। আমার মধ্যে তেমন উৎসাহ নেই। দূর থেকে আর দশটি দ্বীপের মতোই দেখতে। এ আর এমনকি। এই দ্বীপ দেখতেই কি মানুষ সাগর পাড়ি দেয়?
ধীরে ধীরে আমাদের জাহাজটি দ্বীপের কাছাকাছি এগোয়। ক্রমেই গোটা দ্বীপটির সম্মুখ অংশ দৃষ্টিসীমায় আসতে থাকে। তাকাতে তাকাতে আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সমুদ্রের নীলাভ পানিতে ভেসে আছে মায়াবি সেন্টমার্টিন। অন্য কোনও দ্বীপের মতো তো নয়ই। বরং বলা যায় স্বপ্নের কোনও দ্বীপ। সারি সারি নারকেল আর ঝাউগাছের সবুজের ওপর অন্যরকম নীল আকাশ। সাগরের ঢেউ এসে বারবার ধুয়ে দিচ্ছে সমুদ্রতীরের পাথররূপী প্রবালগুলোকে।
দ্বীপের জেটিতে বাঁধা আছে বড় বড় ট্রলার। প্রতিটিতেই পত পত করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। পতাকাগুলো একেবারেই নতুন।
সেন্টমার্টিন দেখতে আসে দুই ধরনের পর্যটক। একদল দু-একদিন থেকে ঘুরে দেখে দ্বীপের লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যকে। আর একদল ঘণ্টা তিনেক সমুদ্রের পানিতে দাপাদাপি করে। পাথর ভেবে কিছু প্রবাল দেখে। আর সেই আনন্দ নিয়েই ক্লান্ত হয়ে ফিরতি জাহাজ ধরে।
একদিনে কি সেন্টমার্টিন দ্বীপের রূপের দেখা মিলে? আমরা থাকব কমপক্ষে দুদিন। সে রকমই পরিকল্পনা। পূর্বদিকের বিচ থেকে দেখব সূর্যোদয় আর পশ্চিম বিচ থেকে সূর্যাস্ত। পূর্ণিমার হিসাব কষেই ঠিক করে রেখেছি সবকিছু।
জাহাজ থেকে নেমে ঘাটের হোটেলগুলোর কাছে আসতেই যেন ক্ষিদে পেয়ে যায়। নানা রকমের সামুদ্রিক মাছ ভাজা হচ্ছে বড় কড়াইয়ের মধ্যে। মাছ ভাজার শব্দে জিভে পানি এসে যায়। চেনা মাছ রূপচাঁদা। কিন্তু সমুদ্রের তাজা কালিচাঁদা, বোল করাল, নাক করাল আর চিংড়ির স্বাদ কি মিলবে অন্য কোথাও। দেরি না করে ঢুকে পড়ি দারুচিনির দ্বীপ নামের হোটেলটিতে।
টেবিলে বসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। একি দিনের আলোতেও এরা টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে কেন? হোটেলের বাবুর্র্চি হারুন জানাল মাছি তাড়াতেই নাকি এ ব্যবস্থা। সত্যি তাই। যে টেবিলে মোমবাতি নেই সেখানে ভনভন করছে অজস্র মাছি।
ঢাকা থেকে বুকিং করে এসেছি সমুদ্রঘেঁষা সীমানা পেরিয়ে রির্সোটে। নিরিবিলি এই রিসোর্টটি কোনার পাড়ায়। দ্বীপের পশ্চিম দিকের বিচের ধারে। খানিকটা ভ্যানে গিয়ে, বাকিটা হাঁটা পথ। লাগেজ টেনে বিরক্তমুখে রিসোর্টের ভেতর পা রাখতেই সব বিরক্তি যেন একেবারে উবে যায়। কটেজগুলো দ্বীপের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। কাঠ আর ইটের সংমিশ্রণে অন্য ঢংয়ে তৈরি। ছোট পদ্ম পুকুর, খেতে খেতে সমুদ্র দেখতে কাঠের উঁচু মাচায় তৈরি করা ডাইনিং আর নানা রঙের ফুলের বাগান মুগ্ধ করে আমাদের।
রুমে ঢুকে বিছানায় গা হেলে দিতেই দু’পাশের বড় জানালায় দেখি নীল আকাশ। ঝিরিঝিরি বাতাসে নারকেল গাছের পাতা নড়ার শব্দ অন্যরকম লাগে। অপরিচিত দু-একটা পাখির ডাক আর সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দে নীরবতা ভাঙে।
সেন্টমার্টিনের এ পাশের দৃশ্যগুলো বেশ অন্যরকম। পর্যটকদের ভিড় খুব কম। সম্মুখ বিচ থেকে বালুময় পথ পার হয়ে কম লোকেরাই সন্ধান পায় পশ্চিমের এই বিচটির। একবার চারুকলার উদ্যোগে ঘুড়ি উৎসব হয়েছিল এ বিচটিতে।
বালিময় পথে পা পড়তেই চোখে পড়ে আল্পনা খচিত পথ। সামুদ্রিক কাঁকড়া মাটি তুলে মনের আনন্দে তৈরি করেছে এমন শিল্পকর্ম। দেখতে অবাক লাগে। বিচের তীরটি ঘিরে রেখেছে সবুজ কেয়াফল গাছ। জানা যায়, এ কেয়াফল গাছই নাকি দ্বীপটিতে জন্মানো প্রথম গাছ।
ভাটার টানে পানি সরে গেলে বিচের সামনে ভেসে ওঠে পাথরের মতো নানা ধরনের বড় বড় প্রবাল। দেখতে বেশ অন্যরকম। একটির ওপর আরেকটি সাজানো। অধিকাংশ পর্যটকই এ পাথরগুলোকেই প্রবাল মনে করেন । অথচ তারা জানতেও পারেন না কত বিচিত্র জগৎ পড়ে আছে এখানে পানির নিচে।
রিসোর্টের ম্যানেজার কামরুল ভাই। তিনি জানালেন, প্রবাল বা কোরাল এক ধরনের জীবিত কীট, যা সাগরের তলদেশে তৈরি করে বিচিত্র বর্ণের ও বাসা। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৯ কিলোমিটার পশ্চিমের সাগরে ডোবা একটি প্রবাল প্রাচীর আছে। ধারণা করা হয়, এটি মালয়েশিয়ার উপকূলের প্রবাল প্রাচীরেরই একটি অংশ। এই দ্বীপে আছে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল। ইস, যদি পানির নিচে গিয়ে দেখে আসতে পারতাম প্রবালের রাজত্ব।
সাগর পারে হাঁটতে হাঁটতে শুনি কামরুল ভাইয়ের কথাগুলো। প্রায় দেড়শ বছর আগে নাকি মিয়ানমার থেকে একদল জেলে মাছ ধরতে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি আবিষ্কার করে।
এখানকার মানুষের প্রধান পেশা সাগরে মাছ ধরা। সন্ধ্যা হলেই জেলেরা নৌকা বা ট্রলার নিয়ে চলে যায় সাগরে। সারারাত বড়শি বা জাল ফেলে অপেক্ষা করে। সকাল বেলা সাগরতীরেই চলে মাছের বিকিকিনি।
সূর্য ডুবতেই চারদিকে জেঁকে বসে চাঁদের আলো। বিধাতা যেন কোনও ঐশ্বরিক আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন আকাশ থেকে। সমুদ্রের পানিতে সাদা চাঁদকে দেখার আনন্দ একেবারেই অন্যরকম।
এরই মধ্যে ঘড়ির কাটায় রাত নয়টা। জোয়ারের চাপে সমুদ্রের পানি উঠে এসেছে অনেক দূর। রিসোর্টের দিকে ফিরতে যাব হঠাৎ দেখি একজন লোক। বালির মধ্যে কিছু একটা খুঁজছে সে। কাছে গিয়ে পরিচিত হই তার সঙ্গে। সিএনআরএস নামক এনজিওতে কর্মরত লোকটি নিজের নাম জানালো নুর আলম। জোয়ারের সময় কাছিমের ডিম সংগ্রহ করাই তার কাজ। সেন্টমার্টিন বিচের এ অংশে জোয়ারের টানে ডিম পাড়তে উঠে আসে বিরল প্রজাতির গ্রিন টার্টেল ও অলিভ টার্টেল। এক একটির ওজন নাকি এক থেকে দেড় মণ। ডিম পাড়ার পর কুকুর কিংবা অন্য কেউ যেন এই ডিম নিয়ে যেতে না পারে সে কারণেই ডিম সংগ্রহ করা হয়। ৫৫ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তা আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। কাছিমরা যেন নির্বিঘ্নে ডিম পাড়তে আসতে পারে সে কারণেই উপকূলের অধিকাংশ আলো রাত ন’টার পর নিভিয়ে দেয়া হয়। অন্ধকারে দু-একটা ডিম দেখে আমরা ফিরতে থাকি রিসোর্টে। ফেরার পথেই সেরে ফেলি পরেরদিন সূর্যোদয় দেখে ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনাটি।
রিসোর্টের মাঠে বিশেষ কায়দায় আগুন জ্বালানো। চেয়ার নিয়ে আমরা গোল হয়ে বসি বার-বি-কিউ’র আনন্দ উপভোগ করতে। মৃদুল তার গীটারে সুর তুলে আপন মনে। আমাদের সঙ্গে জেগে থাকে সমুদ্রের গর্জন আর মায়াবি চাঁদ।
সালেক খোকন