পুরান ঢাকার সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, বাদামতলীর ঘাট, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন ঘাটে প্রতিদিন এপার-ওপার ছোটে অগণিত নৌকা। বুড়িগঙ্গার বুকে এমন নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মাঝি। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই মাঝিরা ভাসিয়ে দেন নৌকা। জীবিকার তাগিদে এমন ছুটে চলা দিনভর। তবে দিনদিন তাদের উপার্জন কমছে। মুখের হাসি হারিয়ে গেছে, কণ্ঠে হতাশার সুর! ইজারাদারের টাকা, মালিকের টাকা, পাহারা ও সিরিয়ালের টাকা—সব দাবি মিটিয়ে নিজের থাকে খুব সামান্য। পরিস্থিতি এমন যে—নৌকা চলে ঠিকই, তবে পেট যেন চলে না।
একাধিক মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদরঘাটে যাত্রী পারাপার হয় কয়েক নিয়মে। কিছু মাঝি যাত্রীদের দূরে নোঙর করা লঞ্চ ধরিয়ে দেন। কিছু মাঝি কেরানীগঞ্জ থেকে সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, বাদামতলী, শ্যামবাজার যাত্রী পারাপার করেন। যারা ঘাট থেকে ঘাটে যাত্রী নামান; তারা আবার দুইভাবে যাত্রী পারাপার করেন। দলগতভাবে ৮-১০ জন যাত্রী নিয়ে যেসব নৌকা যাত্রী পারাপার করেন; তারা প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ৫ টাকা ভাড়া নেন। এককভাবে যে যাত্রী নৌকায় পার হন, তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০-২৫ টাকা। এককথায় একজন পার হতে ভাড়া ৫ টাকা। রিজার্ভ নিলে ২০ টাকা।
সদরঘাটে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবক প্রায় হাজার দুয়েক মাঝি প্রতিদিন খেয়া পারাপার করেন। বেশিরভাগ মাঝি মহাজনদের নৌকা ভাড়ায় চালান। নৌকা ভাড়া ৭৫-৮০ টাকা। ঘাটের ইজারাদারের ভাড়া ৮৫ টাকা। রাতে নৌকা পাহারার বিল ১০ টাকা। সিরিয়াল বাবদ ৫ টাকা। প্রতিদিন খাবারের পেছনে ২০০ টাকা। সব বাদ দিয়ে প্রতিদিন নৌকা চালিয়ে একজন মাঝি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। এমন আয়ে কীভাবে মাঝিদের সংসার চলে? গন্তব্য-ভাড়া-যাত্রা প্রসঙ্গ ছাড়া একটু ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চাইলেই মলিন হয়ে ওঠে মাঝিদের মুখ। কথা বলতেই ফুটে ওঠে জীবনের করুণ চিত্র।
জানা যায়, এসব মাঝি ঢাকায় কেউ কেউ পরিবার নিয়ে থাকেন। কেউ পরিবার রাখেন গ্রামে। একাই নৌকা চালান বুড়িগঙ্গায়। যাদের পরিবার গ্রামে; তাদের অনেকেই ঢাকায় ঘর ভাড়া করেন না। ছোট্ট একটি পোটলা রাখেন নৌকায়। পোটলায় বাঁধা থাকে দু-একটা শার্ট-গেঞ্জি। রাখা হয় লুঙ্গি-গামছা। থাকে একটি চিরুনি, ছোট আয়না, খাবারের থালা বা খুব প্রয়োজনীয় কিছু। এ ছাড়া একটি কাঁথা-বালিশ আর মশারি থাকে নৌকায়। ঝড়, ঢেউ, বৃষ্টি আর মশার যন্ত্রণা মেনেই বুড়িগঙ্গার কোনো এক জায়গায় নৌকা বেঁধে ঘুমান। সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএ ভবন ও পন্টুনের মাঝের জায়গাটুকুতে এমন ঘুমন্ত মাঝিদের প্রায়ই দেখা যায়।
সরেজমিনে জানা যায়, যে কোনো জায়গা থেকে সস্তা খাবার কিনে মাঝিরা নৌকায় বসেই খান। খাওয়ার আগে-পরে হাত কিংবা প্লেট ধুতে হয় বুড়িগঙ্গার পানিতে। বুড়িগঙ্গার পানি যতই খারাপ হোক, মাঝিরা গোসল করেন নদীতেই। নদীর পানি থেকে যেমন গন্ধই আসুক, এ পানি ছাড়া তাদের চলে না। বর্তমানে পানি দূষিত। প্যান্টের কালো পানিতে বুড়িগঙ্গা শেষ। বুড়িগঙ্গার পাশে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে প্যান্ট রং করার অসংখ্য কারখানা গড়ে উঠেছে। কারখানাগুলোর দূষিত পানি ও বর্জ্য এসে মেশে। তারপরও বুড়িগঙ্গা আর নৌকা মাঝিদের কাছে আরাধ্য।
এমনই একজন মাঝি মো. সাহেব আলী (৫৫)। বাবা-মা তার নাম ‘সাহেব’ রাখলেও সাহেবী জীবন তার হয়নি। পেশাগত জীবনে তিনি সদরঘাটের মাঝি। সদরঘাটে নৌকা চালাচ্ছেন ৩৫ বছরের বেশি। পেশার শুরুতে মাত্র ৫০ পয়সা, এক টাকায়ও যাত্রী পারাপার করেছেন। সবকিছুর বদল ঘটেছে। এখন ৫-১০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী পার হয়। এই পারাপারেও তার সংসার চলে না। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক ধার-দেনা করে। পরিবারের কারণে অল্প লেখাপড়া করা ছেলেটাও কাজে জড়িয়েছেন। অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ আর থাকার খরচ শেষে সাহেবের ঘরে খাবারে টান পড়ে। এভাবেই টেনেটুনে তাদের পেট চলে।
সাহেব আলী বলেন, ‘ঢাকায় যেমন লোক বেড়েছে, কেরানীগঞ্জে চাপ বেড়েছে। আলম মার্কেটের ব্যবসা বেড়েছে। এসব কারণে নৌকায় পারাপারের যাত্রী একেবারে কম না। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার মাঝির পরিমাণও বাড়ছে। শুধু আয় বাড়েনি। গত ১০ বছর আগেও ৩০০-৪০০ আয় হতো। এখনো একই রকম।’
আরেক মাঝি হাবিবুর রহমান। ৪০ বছর বয়সের এই মাঝির বাড়ি পিরোজপুরে। জীবিকার তাগিদে একাই ঢাকা থাকেন। সদরঘাটে নৌকায় থাকেন। ভাড়া নিয়ে নৌকা চালান। ঢাকার এত কষ্টার্জিত টাকা তিনি গ্রামে পাঠান। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সব চাহিদা মেটে হাবিবুরের আয়ে। এসব চিন্তা করে যতই কষ্ট হোক, হাবিবুর তা মেনে নেন।
তিনি বলেন, ‘সদরঘাটের মাঝিদের জীবন দুর্বিষহ। মাসের পর মাস গেলেও নিরিবিলি-শান্তির একটু ঘুম হয় না। মনে চাইলেও একটু ভালো খাওয়া হয় না। সবকিছুর দাম বাড়লেও নৌকার ভাড়া বাড়েনি। করোনাকালে দিনভর ৫০ টাকাও হতো না। আমার মতো কতো মাঝি ঋণ করে চলেছে। সেই ঋণ অনেকেই এখনো শোধ করতে পারেনি। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, এভাবে আর কতদিন কষ্ট করবো। তবুও এই কাজ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করি না। এটাই শিখেছি, অভ্যাস হয়ে গেছে। মায়ায় পড়ে গেছি।’
মাঝিদের সঙ্গে গল্প জমতেই পাশ থেকে সুর মেলালেন অনেকেই। নাম-পরিচয় ভিন্ন হলেও গল্পগুলো অভিন্ন। সবার মুখেই একই কথা। সবার চোখে হতাশার ছায়া। সবার কপালেই ক্লান্তির রেখা। এই যুগে না ঠেকলে কেউ মাঝি হতে চাইবেন না। কোনো মা তার ছেলেকে মাঝি হতে দেবেন না। এত প্রতিকূলতার পরও নৌকা ভাসে। এই পেশায় জড়িতরা বাঁচেন। নৌকার সঙ্গে নিজেকেও ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার কারণ ‘ভালোবাসা’। পেশার প্রতি ভালোবাসা, অভ্যস্ততা, নদীর প্রতি মায়ায় বাঁধা পড়েছেন তারা। ভালোবেসেই নৌকা চালান সদরঘাটের মাঝিরা। ভালোবাসার কাছে হার মেনে যায় মাঝিদের শত কষ্টের গল্পগুলো।