পর্যটন শহর কক্সবাজার যুক্ত হতে যাচ্ছে দেশের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে। আগামী বছরই সমুদ্রতীরবর্তী শহরটির সঙ্গে রেল যোগাযোগ শুরু হবে। পর্যটনকে প্রাধান্য দিয়েই সাজানো হচ্ছে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি হবে এশিয়ার একমাত্র পর্যটনকেন্দ্রিক সুবিধাসংবলিত স্টেশন। ছয়তলাবিশিষ্ট স্টেশনটিকে দেশের অন্যতম ও দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ স্টেশন চালুর পর কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম কয়েক গুণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, আইকনিক এ রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণের পর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ৪৬ হাজার যাত্রী কক্সবাজারে প্রবেশ এবং ৪৬ হাজার যাত্রী কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের জন্য ট্রেনে চড়বে। রেলসংযোগের ফলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছাড়াও কক্সবাজার জেলার অন্য পর্যটন এলাকাগুলোয় দ্বিগুণেরও বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটবে।
প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া হচ্ছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫ বর্গফুট। সারা বিশ্বের পর্যটকদের চিন্তা মাথায় রেখে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোর পাশাপাশি একজন পর্যটককে যেন ভ্রমণসংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়তে না হয়, বেড়াতে এসে বাড়তি খরচ করতে না হয়, সেসব দিকে লক্ষ রেখেই বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা হচ্ছে। একজন পর্যটক চাইলে সকালে কক্সবাজার স্টেশনে নেমে সারা দিন ঘুরে আবার ফিরতি ট্রেনে ফিরে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধা থাকবে কক্সবাজার রেলস্টেশনে। পর্যটকদের যেন বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্য স্টেশনে সব ধরনের ব্যবস্থা রাখছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণ পর্যটক আসে তাদের অর্ধেকই আসে একদিনের জন্য। বিশেষ করে সমুদ্রে গোসল করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। কারণ সঙ্গে থাকা মালপত্র রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। এ সমস্যার সমাধানে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। কেউ চাইলে লকারে ব্যাগ কিংবা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে সৈকতে ঘুরতে পারবে। থাকবে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা আধুনিক স্নানাগার। এছাড়া অভ্যর্থনা কক্ষ, তারকামানের হোটেল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, মাতৃদুগ্ধ পান কেন্দ্র, ফার্মেসি, বুক শপ, পোস্ট অফিস, এটিএম বুথ, ফরেক্স সেবা, মসজিদ ও প্রার্থনা কক্ষ, ওয়েটিং লাউঞ্জ, আপার ক্লাস ওয়েটিং লাউঞ্জ, ভিআইপি ওয়েটিং লাউঞ্জ, ইনফরমেশন ডেস্ক, চিলড্রেন প্লে সেন্টার, ক্যাফে, শপিং সেন্টার ইত্যাদি। সম্পূর্ণ রেলওয়ে স্টেশনটিতে থাকবে কেন্দ্রীয় শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।
কক্সবাজার মূল সমুদ্রসৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে রেলওয়ে স্টেশন। এর প্রথম ফ্লোর বা ডিপারচার লাউঞ্জে রয়েছে ছয়টি লিফট, পাঁচটি সিঁড়ি, চার ইউনিট ওয়াশ রুম, তিন রুমের বেবি কেয়ার, দুটি এক্সিলেটর, ওয়েটিং লাউঞ্জ, আপার ক্লাস ওয়েটিং লাউঞ্জ, ভিআইপি ওয়েটিং লাউঞ্জ, এক রুমের লকারস সিস্টেম, একটি ইনফরমেশন ডেস্ক, শপ অথবা ডিসপ্লে সেন্টার এরিয়া, একটি প্রেয়ার রুম এবং ফুটওভার ব্রিজের সঙ্গে সংযুুক্ত প্যাসেঞ্জার ডিপারচার লাউঞ্জ।
দ্বিতীয় ফ্লোরে প্রথম ফ্লোরের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও থাকবে দ্বিগুণ পরিসরের শপ অ্যান্ড শোরুম। এ ফ্লোরে রাখা হয়েছে একটি সুপরিসর রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় ফ্লোরে অন্যান্য ফ্লোরের মতো সুবিধা ছাড়াও ৩৯ রুমের আবাসিক হোটেল ও হোটেল ডাইনিং স্পেস থাকবে। চতুর্থ ফ্লোরে অন্য সুবিধাগুলোর পাশাপাশি থাকবে অফিস ও কনফারেন্স রুমের সুবিধা। যেগুলো লিজ দেয়া হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে পঞ্চম ফ্লোর বর্ধিত করা হলে সেখানে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ ফ্লোরের বিভিন্ন সুবিধা সংযোজিত হবে।
আইকনিক এ স্টেশনে গ্রাউন্ড ফ্লোরের কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত। নিচতলায় আরো থাকবে তিনটি মূল প্রবেশপথ, একটি ভিআইপি প্রবেশপথ, প্লাটফর্ম লেভেল দুটি যাত্রী নামার পথ, সার্ভিস খাত হিসেবে একাধিক জনপ্রিয় ব্যাংকের অটোমেটিক ট্রেলার মেশিন (এটিএম বুথ), পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, ফরেক্স সেবা সার্ভিস ছাড়াও বিভিন্ন নিত্য সেবা কেন্দ্র। এছাড়া নিচতলায় থাকবে দুটি সুপরিসর বিপণি কেন্দ্র, ফার্মেসি, ট্রলি ট্র্যাকিং এরিয়া (্যাারাইভাল/ডিপারচার), লাগেজ ও লকার্স রুম, সাতটি টিকেট কাউন্টার, একটি রিজার্ভেশন কাউন্টার।
চীন, তাইওয়ান, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে বড় বড় অনেক রেলওয়ে স্টেশন থাকলেও এশিয়ায় কেবল পর্যটকদের কথা চিন্তা করে সাজানো কোনো রেলওয়ে স্টেশন নেই। সেদিকটা মাথায় রেখেই নির্মাণ করা হচ্ছে এ স্টেশনটি।
কনস্ট্রাকশন অব সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ রেলওয়ে ট্র্যাক ফ্রম দোহাজারী টু কক্সবাজার ভায়া রামু অ্যান্ড রামু টু ঘুনধুম নিয়ার মিয়ানমার শীর্ষক এ প্রকল্পটির সূত্রে জানা গিয়েছে, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-ক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কক্সবাজার অংশে দৃষ্টিনন্দন ‘আইকনিক রেলস্টেশন’ বিল্ডিংয়ের মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ। ছাদের ওপর বসানো হচ্ছে মূল স্টিল ক্যানোপি। একই সঙ্গে চলছে সৌন্দর্যবর্ধন, গ্লাস ফিটিং, ফায়ার ফাইটিং, স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ। ২৯ একর জমির ওপর ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রেলস্টেশনটি দেখতে অনেকটা ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হবে।
দেশের অন্যান্য রেলস্টেশন থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন সুপরিসর ড্রপ এরিয়া, ২৪টি বাসের পার্কিং এরিয়া, ১৬৮টি প্রাইভেট ও মাইক্রোবাসের পার্কিং এরিয়া ছাড়াও ১৮০টি থ্রি হুইলারের জন্য পার্কিং এরিয়া।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আগামী বছরের মধ্যে রেলপথের নির্মাণকাজ শেষে প্রকল্পটি যাত্রী চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন হবে, এমনভাবেই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যটনের শহর হওয়ায় পুরো স্টেশনটিতে পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অধীন প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয় ২০১০ সালের ৬ জুলাই। শুরুতে সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজ রেল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় রেলপথটি ডুয়াল গেজ নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের সংশোধিত প্রাক্কলন নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। বাকি ৬ হাজার ৩৪ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।