শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৩ অপরাহ্ন

লিজ ফাঁদে ‘ডানাভাঙা’ বিমান

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩

লিজে নেওয়া দুটি এয়ারক্রাফট গত বছর কিনতে বাধ্য হয় বিমান। নানা কৌশলে ‘রদ্দি মাল’ দুটি গছিয়ে দেওয়া হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে একই প্রক্রিয়ায় বহরের জন্য অনুপযুক্ত আরও একটি এয়ারক্রাফট গছানোর ‘ধান্দা’ শুরু করেছে একটি চক্র।

যদিও বিমানের ‘হাই অফিশিয়াল’ এ চক্রের ফাঁদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই এয়ারক্রাফট লিজ প্রক্রিয়ায় যেন বাণিজ্যিক মধ্যস্থতা না ঘটে, সেদিকে নজর রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রথমে লিজের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে তা কিনে নেওয়ার মুলা ঝোলানো হয়েছে। গত বছর যেহেতু লিজে নেওয়া এয়ারক্রাফট কিনে নিয়েছে এবারও কিনবে বা লিজের মেয়াদ বাড়াবে বিমানএমন ছক থেকেই দাবার বোর্ডের ঘুঁটি চালাচালির মতো ফাইল চালাচালি শুরু হয়েছে।

কিন্তু বিমানের শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, কেনা তো নয়ই, এই এয়ারক্রাফটের লিজের মেয়াদও বাড়ানো ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা ফেরত দিতে হবে। তা না হলে এই এয়ারক্রাফট লিজে নেওয়া অন্য এয়ারক্রাফটের মতো বিমানের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াবে। আর ভবিষ্যতে লিজ থেকেও বের হয়ে আসতে হবে বিমানকে।

বিমানবহরে বর্তমানে ২১টি এয়ারক্রাফট রয়েছে। এর মধ্যে ড্যাশ-৮ মডেলের রয়েছে ৪টি। ড্যাশগুলোর মধ্যে এমএসএন ৪২০৮ এস২-এজেডব্লিউ মডেলের এয়ারক্রাফটির লিজের মেয়াদ আগামী ১২ সেপ্টেম্বর শেষ হবে। এয়ারক্রাফটটি নোরডিক এভিয়েশন থেকে মাসে ১ লাখ ২৬ হাজার ডলারে ৫ বছরের জন্য ড্রাই লিজে আনা হয়। ড্রাই লিজের শর্ত অনুযায়ী, এয়ারক্রাফট যে অবস্থায় আনা হয়, সেই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে; অর্থাৎ এয়ারক্রাফটির ইঞ্জিন, বডিসহ সবকিছুই লিজ নেওয়ার প্রথম দিনের মতো বা অবস্থায় থাকতে হবে। নোরডিক হচ্ছে বিশে^র অন্যতম নামকরা এয়ারক্রাফট লিজিং কোম্পানি। বিশ্বখ্যাত অনেকগুলো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে নোরডিকের। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক এই কোম্পানি থেকে এর আগেও এয়ারক্রাফট লিজ নিয়েছে বিমান। সেই সব লিজের পরিণতিও ভালো হয়নি।

লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে থাকায় লিজদাতা বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। গত বছরের ৩ মাার্চ লিজদাতা কম ভাড়ায় এয়ারক্রাফটির লিজের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এবারে তিন বছরের জন্য লিজ দিতে চায়। প্রতি মাসের ভাড়া ৬৩ হাজার ৫০০ ডলার। ১২ মাসের জন্য লিজ নিলে ভাড়ায় ২০ শতাংশ ছাড় দেবে। প্রস্তাবিত বর্ধিত মেয়াদের লিজ প্রক্রিয়ার মধ্যেই নোরডিক এভিয়েশন এয়ারক্রাফটির মালিকানা হাতবদল করতে চায়। তারা এয়ারক্রাফটি তাদেরই সহযোগী সংস্থা এনএসি এভিয়েশনের নামে হস্তান্তর করতে চায়। মেয়াদ বাড়ানোর পূর্বশর্ত হিসেবে বিমানকে মালিকানা হস্তান্তরে সহযোগিতার অঙ্গীকার করতে হবে।

লিজ প্রস্তাবের মেয়াদ গত বছরের ৪ মার্চ শেষ হয়ে গেলেও নোরডিক এভিয়েশন মৌখিকভাবে প্রস্তাবটি বহাল আছে বলে বিমানের পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জানিয়েছে। এ বিষয়ে নোরডিক বিমান কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। লিজদাতা এয়ারক্রাফটি কম দামে কিনে নেওয়ার জন্য বিমান কর্তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। বিমানের বাইরে থেকেও এ বিষয়ে লবিং করাচ্ছে লিজদাতা।

লিজের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব গত ১৪ ডিসেম্বর বিমানের নির্বাহী পরিচালকমন্ডলীর সভায় উপস্থাপন করা হলে সভা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট পরিদপ্তরকে ফেরত দেওয়ার খরচ নিরূপণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এয়ারক্রাফটটি যে অবস্থায় আনা হয়েছে, সেই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি কেনা এবং বাণিজ্যিক মধ্যস্থতা যেন না ঘটে, সেদিকে নজর রাখার জন্য বৈঠকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে কোনো সংস্থার সঙ্গে যেকোনো ধরনের চুক্তি করার আগে দক্ষ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে চুক্তি করা হবে, যেন বিমানের আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষতি না হয়এ সিদ্ধান্তও বৈঠকে নেওয়া হয়।

এয়ারক্রাফট ফেরত দেওয়ার জন্য নির্বাহী পরিচালকম-লীর গত ১৫ ফেব্রুয়ারির সভায় বলা হয়, ‘যেহেতু লিজকৃত এয়ারক্রাফট ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই এবার ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।’

একজন পরিচালক জানিয়েছেন, অতীতের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা এবারও এড়াতে পারবে না বিমান। অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে লিজ নেওয়ার আগেই পরামর্শ করা হয়েছিল। লিজ নেওয়ার বিষয়ে তারা ভিন্ন কোনো মত দেয়নি। ফেরত দেওয়ার সময় অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেও ফলদায়ক কিছু হবে না। কারণ যা শর্ত আছে, তা থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।

বর্তমান বিমান বহরে থাকা ড্যাশ-৮-৪০০ এয়ারক্রাফট লিজের মেয়াদ শেষে ফেরত দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এয়ারক্রাফটের অনেক পার্টস বাজারে নেই। বাজারে পার্টসই যদি না থাকে তাহলে লিজ নেওয়ার সময়ের অবস্থানে কীভাবে নেওয়া যাবে ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফটকে? তাহলে নির্ঘাত আরও একটি ঘটনা লিজকা-ে যোগ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।

মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে দুটি এয়ারক্রাফট লিজে এনে বিমানকে প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা করে লোকসান দিতে হয়েছিল। অসম চুক্তির কারণে লিজের সেসব এয়ারক্রাফট ফেরত দিতে বেগ পেতে হয় বিমানকে। ওই দুটি এয়ারক্রাফেটর জন্য রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইনসকে মোট ৬০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। এ অভিযোগ এখনো তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এটা শুধু লিজকা-ের একমাত্র ঘটনা নয়। আরও অনেক অনেক ঘটনার একটি মাত্র।

নাইজেরিয়ার কাবো এয়ারলাইনসের ২০ বছরের পুরনো এয়ারক্রাফট লিজে আনা নিয়েও জটিলতা হয়েছিল। কয়েকটি দেশ এ এয়ারক্রাফটটি নামতে বাধা দিয়েছিল। ডিসি ১০ এবং এয়ারবাসের দুটি এয়ারক্রাফট নিয়েও জটিলতা কম হয়নি। মাসের পর মাস বসিয়ে রেখে জরিমানা গুনতে হয়েছিল বিমানকে। লিজ নিয়ে নানা কা-ের পর একই পথে হাঁটছে বিমান। মন্ত্রণালয়ের কমিটি, বিশেষজ্ঞ কমিটি, এমনকি সংসদীয় কমিটির সাফ কথাবিমানকে লিজে এয়ারক্রাফট আনা বন্ধ করতে হবে। এসব কমিটির কথা আমলে না নিয়ে বিমান হাঁটছে নিজের মতো করে। অভিযোগ উঠেছে, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিমানকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারাই নেপথ্যে থেকে বিমান কর্তৃপক্ষকে লিজ নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন এয়ারক্রাফট কেনা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের পথ বাতলে দিচ্ছে।

বিমানবহরে অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনারই আছে অর্ধডজন। বোয়িংয়ের ৭৩৭, এমনকি ছোট আকারের ড্যাশও আছে। এতগুলো নতুন এয়ারক্রাফট দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এয়ারলাইনসের নেই। সেই সব অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট হেলায় নষ্ট করছে। প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটকে কার্গো ফ্লাইটে রূপান্তর করা হচ্ছে। এ জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক, তা করেনি বিমান। এতে এয়ারক্রাফটের সিট, হ্যান্ড লাগেজ কেবিন, মনিটর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কার্গো বা মালামাল পরিবহন করে যা আয় হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে কেবিন, সিট বা মনিটর ভাঙার কারণে।

ড্যাশ ৮ এয়ারক্রাফটের মেয়াদ বাড়ানো বা কিনে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিমানের হাই অফিশিয়ালরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেও তাদের কথা বলতে রাজি করানো যায়নি। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকেও একই কথা বলা হয়েছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিমানের ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফট লিজে আনা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বেসরকারি কয়েকটি এয়ারলাইনস শুরুতে ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফট নিয়ে এলেও তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং এয়ারক্রাফট ফেরত দিয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে যখন প্রাইভেট এয়ারলাইনসগুলো ড্যাশ-৮ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, তখনো বিমান ড্যাশেই মজে আছে। এ ধরনের এয়ারক্রাফট নেওয়ার আগে তারা কোনো ফিন্যান্সিয়াল ফিজিবিলিটি স্টাডি করেনি।’

বিমান ড্রাই লিজ অনুসরণ করে কেন? এর বিশেষ কোনো সুবিধা আছে কি না জানতে চাইলে বিমানের সাবেক এ পরিচালক বলেন, বিমানের জন্য ড্রাই লিজ অত্যন্ত খারাপ একটা চুক্তি। এই চুক্তির সমস্যা হলো যে অবস্থায় এয়ারক্রাফট বহরে যোগ হলো, সেই অবস্থায় তা ফেরত দিতে হবে। এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। একটা চেয়ারও যদি পাঁচ বছর ব্যবহার করা হয় তা আর আগের অবস্থায় ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়। বিমান যতবার ড্রাই লিজ নিয়েছে, ততবারই ঝামেলা হয়েছে। প্রতিবার বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ড্রাই লিজের এয়ারক্রাফট ফেরত দিতে হয়েছে। ডিসি-১০সহ আরও কিছু ড্রাই লিজ থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পায়নি বিমান। তখন বাধ্য হয়ে রেখে দিতে হয়।

এ জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে এয়ারলাইনসগুলো কী করতে পারেজানতে চাইলে কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, লিজের শুরুতেই মেইনটেন্যান্স রিজার্ভ বলে একটা ফান্ড করতে হয়। এয়ারক্রাফট ফেরত দেওয়ার সময় সেই ফান্ড থেকে খরচ করতে হয়। তাহলে এয়ারলাইনসগুলোকে বেগ পেতে হয় না। এয়ারলাইনসগুলোর জন্য সবচেয়ে ভালো হয় লিজ বেসিস পারচেজে যাওয়া। লিজের কিস্তির টাকা দিয়েই এয়ারক্রাফটের মালিক হওয়া যায়। এর প্রিমিয়ামটা একটু বেশি হলেও এটাই সুবিধাজনক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com