সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন

লাইসেন্স ছাড়াই ফ্লাইট

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩

লাইসেন্স ছাড়া যাত্রীবাহী ফ্লাইট পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে দুই পাইলটের বিরুদ্ধে। তারা হলেন-ক্যাপ্টেন শাকিল আলী ও ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামান। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ বিমানের দুই পাইলটের কমার্শিয়াল লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তাদের দিয়ে তিন মাস ফ্লাইট পরিচালনা করিয়েছে বিমানের শিডিউলিং বিভাগ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এবং এভিয়েশন নিউজের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা যায়, ক্যাপ্টেন শাকিল আলী সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স নামে একটি বিমান সংস্থার অধীনে হেলিকপ্টারের ফ্লাইট চালাচ্ছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-গত বছর নভেম্বরে তার কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্সের (সিপিএল) মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর নবায়ন না করে তিনি তিন মাস ধরে ওই কোম্পানির অধীনে ঝুঁকি নিয়েই ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিলেন। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন (এফএসআর) বিভাগের পরিদর্শনে এই ভয়াবহ অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ঘটনায় তদন্ত হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটি রিপোর্টও দেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই পাইলটের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি লাইসেন্স ছাড়া মোট ১৯টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। সাকিল আলী সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের অধীনে চাকরি করলেও তার হেলিকপ্টারটি ছিল আকিজ গ্রুপের মালিকানাধীন।

এর আগেও এই পাইলটের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার লালবাগে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরসহ ৬ জন আহত হয়েছিলেন ওইদিন। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনে ত্রুটির কথা বলা হলেও পরে জানা যায়, পাইলটের ভুলের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। তদন্তে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না বলেও প্রস্তুতকারী কোম্পানি নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শাকিল আলী তখন অ্যারো টেকনোলজিস্ট লিমিটেড (এটিএল) নামে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে ইমপ্রেস এভিয়েশনের মালিকানাধীন হেলিকপ্টার চালাতেন তিনি।

অপর একটি ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানের দুই পাইলটের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বিমান সংস্থাটির শিডিউলিং বিভাগ দুজনকে দিয়ে তিন মাস ফ্লাইট পরিচালনা করিয়েছেন। বেতনের খাতায় চেক করতে গিয়ে প্রশাসন বিভাগের মাধ্যমে এই তথ্য ফাঁস হয়। একপর্যায়ে তাদের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়। পরে তড়িঘড়ি করে দুই পাইলটের অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়টি ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। দুই পাইলটের একজন বিমানের সাবেক এমডি মোসাদ্দেক আহম্মেদের ভাই ক্যাপ্টেন মাকসুদ।

এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া এক পাইলটের বিরুদ্ধে বিমানের একটি যাত্রীবাহী ফ্লাইট (বিজি৩৩৬) পরিচালনার গুরুতর অভিযোগ আছে। খোদ সিভিল এভিয়েশনের এক ফ্লাইট অপারেশন ইনস্পেকটরের (এফওআই) বিরুদ্ধে উঠেছে এই অভিযোগ। ১৫ জানুয়ারি জেদ্দা থেকে ঢাকা আসার পথে ঘটে এই ঘটনা। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ককপিটে পাইলটের পেছনের আসনে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার কথা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ককপিটে পাইলটের আসনে বসে পুরো ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছেন। আর ওই সময় মূল পাইলট ক্যাপ্টেন দিলদার আহমেদ তোফায়েল তার আসন ছেড়ে রেস্ট ব্যাঙ্কে গিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। পাইলটদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো বৈমানিক ফ্লাইট চলা অবস্থায় ক্যাপ্টেনের আসনে বসা ফৌজদারি অপরাধ। বেবিচকের এই ফ্লাইট অপারেশন ইনস্পেকটরের নাম ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামান।

যেভাবে এই তথ্য ফাঁস হয় : জানা যায়, ফ্লাইটটি ভারতের আকাশ অতিক্রম করার সময় কবির আহমেদ নামে এক সৌদি প্রবাসী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় ফ্লাইটে থাকা এক চিকিৎসক জরুরি ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী কোনো বিমানবন্দরে ফ্লাইটটি অবতরণের অনুরোধ জানান পাইলটকে। কিন্তু মূল পাইলট রেস্ট ব্যাঙ্কে ঘুমিয়ে থাকায় আকস্মিকভাবে বেবিচকের লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ পাইলট ফরিদুজ্জামান ফ্লাইটটি অবতরণের চেষ্টা করেও পারেননি। তিনি সোজা ঢাকায় ফিরে আসেন। যার কারণে বিনা চিকিৎসায় ওই যাত্রী হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে পুরো চিত্র।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও সিভিল এভিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন  বলেন, এ ঘটনায় বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের দুই পাইলটকে সাসপেন্ড ও ডিউটি থেকে অফ করে দেওয়া উচিত ছিল। আর বেবিচকের যে ইনস্পেকটর ককপিটে ক্যাপ্টেন সিটে বসছেন, তাকেও ডিউটি থেকে অফ করে দেওয়া উচিত ছিল। যদিও তিনি অনেক সিনিয়র একজন বৈমানিক, ইট ডাজ নট মেটার। রুল ইজ ফর এভরিবডি। তিনি বলেন, লাইসেন্স ছাড়া হেলিকপ্টার কিংবা কোনো বিমান সংস্থার ফ্লাইট পরিচালনা করা আইনগতভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ঘটনায় পাইলটের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হওয়ার কথা। একইভাবে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানাসহ লাইসেন্স স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম।

সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের অভিযুক্ত পাইলট ক্যাপ্টেন শাকিল আলী  জানান, তিনি বিমানবাহিনীর সাবেক একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। তিনি একজন ইনস্ট্রাকটরও। পাইলটদের ট্রেনিং করানোসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষাও তিনি নিয়ে থাকেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। উলটো সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তাদের কিছু ক্ল্যারিক্যাল ভুল ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানান, তার সিপিএল লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে এতদিন তার লাইসেন্স নবায়ন করেনি। বাধ্য হয়ে তাকে ফ্লাইট করতে হয়েছে।

বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী  বলেন, এসব ঘটনায় আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। বিমানের ফ্লাইটে সৌদি প্রবাসীর মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পাইলট ও সিভিল এভিয়েশনের লাইসেন্সবিহীন পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একজনকে শোকজ করা হয়েছে। তদন্ত হবে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লাইসেন্স ছাড়া হেলিকপ্টার পরিচালনার বিষয়েও আমরা তদন্ত করে দেখব।

যেভাবে শাকিল আলীর তথ্য ফাঁস হয় : বেবিচক সূত্র জানায়, সম্প্রতি একজন পাইলট তার সিপিএল লাইসেন্সের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সিভিল এভিয়েশনে আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি ক্যাপ্টেন শাকিল আলীকে তার ফ্লাইট অপারেশন ইনস্ট্রাকটর (এফওআই) হিসাবে নাম দেন। নিয়ম হলো, কোনো উড়োজাহাজ কিংবা হেলিকপ্টারের ইনস্ট্রাকটর হতে হলে ওই হেলিকপ্টারের ওপর সংশ্লিষ্ট ইনস্ট্রাকটরের ‘কারেন্ট’ বা রেটেড থাকতে হয়। ৯০ দিনের মধ্যে ওই হেলিকপ্টারে ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এছাড়া ওই ইনস্ট্রাকটর মেডিক্যালি ফিট হতে হয়। এ ধরনের একটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একজন ইনস্ট্রাকটরের অধীনে কমপক্ষে ১৫০ ঘণ্টা ফ্লাই করতে হয়। এ কারণে বেবিচক কর্তৃপক্ষ এফওআই হিসাবে ক্যাপ্টেন শাকিল আলীর যোগ্যতা আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে যায়। তাতেই ফাঁস হয়ে পড়ে তার সিপিএল-এর মেয়াদ নেই। এ ঘটনায় বেবিচকজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লাইসেন্স ছাড়া এবং চুক্তি নবায়ন ব্যতীত যে কোনো পাইলটের ফ্লাইট পরিচালনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিমানের দুই পাইলট যখন চুক্তি নবায়ন ছাড়া ফ্লাইট করেছেন, তখন যদি দুর্ঘটনা ঘটত, তাহলে দেশে-বিদেশে বড় ধরনের ভাবমূর্তির সংকটে পড়ত রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। তাছাড়া বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এয়ারক্রাফটগুলো বিমানবহরের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ। এ ধরনের একটি উড়োজাহাজের মূল্য প্রায় ১২শ কোটি টাকা। যাত্রীদের জীবন, ইনসুরেন্স তো আছেই। এভাবে চুক্তিবিহীন কোনো পাইলটের হাতে এরকম মূল্যবান উড়োজাহাজ তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি শিডিউলিং বিভাগের। এ ঘটনায় দুই পাইলটের পাশাপাশি শিডিউলিং বিভাগের সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হওয়া উচিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন বৈমানিক যতই দক্ষ এবং সিনিয়র হোক না কেন, চুক্তি না থাকলে তিনি ওই কোম্পানির অফিসিয়াল পাইলট নন। ফ্লাইট পরিচালনা করতে হলে তাকে অবশ্যই নতুন করে চুক্তি নবায়ন করতে হবে। আর কমার্শিয়াল ফ্লাইট দূরের কথা, লাইসেন্স ছাড়া ককপিটেও বসার সুযোগ নেই।

এ ঘটনা জানতে বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন্স ক্যাপ্টেন ছিদ্দিকুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। চিফ অব শিডিউলিং ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক হুসেনও টেলিফোন রিসিভ করেননি।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজীম  বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও দুই পাইলটের ফ্লাইট পরিচালনা করতে কোনো অসুবিধা নেই। তাদের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি আন্ডার প্রসেস। তাছাড়া চুক্তি নবায়ন ভূতাপেক্ষও হতে পারে। শুধু তারা দুজনই নয়, এরকম আরও ১০-১২ জন আছেন। সবার চুক্তি একসঙ্গে হবে। তাছাড়া এর সঙ্গে শুধু বিমান একা নয়, এখানে সিভিল এভিয়েশনের অনেক কাজ আছে। বিমান এমডি আরও বলেন, পাইলটদের চুক্তির মেয়াদ নবায়নযোগ্য। যেহেতু চুক্তি এক বছরের, তাই ৬৫ বছর পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন সাপেক্ষে ফ্লাইট চালাতে পারবেন।

তবে পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ এয়ারলাইন পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাবেক একজন কর্মকর্তা  বলেন, বাপার সঙ্গে বিমানের যে অ্যাগ্রিমেন্ট ছিল তাতে আগে কোনো পাইলটের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে ৩ মাস আগে চুক্তি নবায়ন করতে হতো। আগে বিমানের লাইসেন্সধারী পাইলটদের চাকরির বয়স থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তি নবায়ন হয়ে যত। কিন্তু কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস চলাকালীন বিমান ম্যানেজমেন্ট এই চুক্তি বাতিল করে দেয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো পাইলটের চুক্তি শেষ হওয়ার পর যথাসময়ে নবায়ন না হলে তিনি আর বিমানের পাইলট নন।

বেবিচক ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন (এফএসআর) বিভাগের সদস্য এয়ার কমোডর শাহ কাওসার আহমেদ চৌধুরী  বলেন, বিমানের পাইলটদের চুক্তি নবায়নের বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের করণীয় কিছু নেই। এটা বিমানের একান্ত ব্যক্তিগত। তবে লাইসেন্সবিহীন ফ্লাইট অপারেশনের বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com