বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

রোমের পথে পথে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০২৩

প্রাচ্যীয় এ রোমান সম্রাট ৬১০ থেকে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। খ্রিস্টধর্ম  এবং ইসলাম ধর্মের তৎকালীন ইতিহাসেও তার উপস্থিতি ও গুরুত্ব বিদ্যমান।

ছোটবেলায় ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত একটি ট্রান্সলেশন শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম- রোম শহর একদিনে গড়ে ওঠেনি, রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে।

সুইডেনে আসার পর থেকেই আমার খুব ইচ্ছে জেগেছে এ নগরটি কেমন তা দেখতে। ইতালির রাজধানী রোমে হাঁটছি আমি আর আমার বন্ধু দুজন মিলে। সে পিএইচডি করছে আনকোনা ইউনিভার্সিটিতে। আজ সকালে আসছি আমি ইতালির নাপোলি শহর থেকে, ট্রেনে। আর সে আসছে তার শহর আনকোনা থেকে।

ভ্রমণ কাহিনি: রোমের পথে পথে
হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া, সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটার দূরত্ব। খিদে পেয়েছিল দুজনেরই। আমি বললাম, চলো আগে কিছু খাই, তারপর হোটেলে যাব। অনেকগুলো খাবার হোটেল চোখে দেখলাম।

হঠাৎ দেখলাম এক বাঙালি চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল- ভাইয়া আসেন, আমাদের এখানে খেতে পারবেন।

দেশি ভাই এভাবে ডাকছে দেখে ভালোই লেগেছে। গরম গরম পরোটা, ডাল, গরুর কলিজা দিয়ে সারলাম সকালের নাস্তা। পেমেন্ট করতে যাব, দেখি টোটাল যা আসছে তা থেকে দুই ইউরো কম নিয়েছে। ম্যানেজার ভদ্রলোক বললেন, আমরা সবাই দেশি ভাই তো, সমস্যা নাই। আপনারা আসবেন এখানে।

খুব ভালো লেগেছে বিদেশে দেশি ভাইটির আন্তরিকতায়। এ শহরে আমরা দুজনেই নতুন। সে ইতালিতে থাকে প্রায় বছরখানেক আগে থেকে, কিন্তু রোম শহরে আজই প্রথম। হোটেলের ভাইটি আমাদের অনেক গাইডলাইন দিলেন ভ্রমণ সম্পর্কে।

যা হোক, আমরা হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম শহর নগর ভ্রমণে। ইতালিয়রা তাদের রাজধানী শহরকে ‘রোমা’ নামে ডাকেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩-এ রোম শহরের প্রতিষ্ঠা। রাজা রোমিউলাসের নামে এ শহরটির নামকরণ। ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে এ শহরের একটা বিশেষ অংশ নির্ধারিত হয়েছে।

ভ্রমণ কাহিনি: রোমের পথে পথে
ইউরোপের যতগুলি দেশে আমি ভ্রমণ করেছি তার মধ্যে ইতালিকে আমার কাছে একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এখানে সবকিছুই আছে- পাহাড়, সমুদ্র, বিশ্ব ঐতিহ্য আর ইতিহাস বিজড়িত অনেকগুলো জায়গা। খ্রিস্টপূর্ব এবং খ্রিস্টাব্দের সময়ের অনেক ঘটনার সাক্ষী এ ইতালি। এখানে আছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি কলসিয়াম ও ভিসুভিয়াস-আগ্নেয়গিরি। আছে পম্পেই নগরীসহ অনেক বিশ্ব ঐতিহ্য, আবার অন্যদিকে আছে ভেনিস নগরী যে নগরীর প্রধান বাহন নৌকা, স্পিডবোট ও প্রমোদতরী।

মোটামুটি এ কারণেই ইতালি দেশটি আমার কাছে বেশি নজর কেড়েছে। ইতালিতে হাজারো বিদেশির বসবাস। আফ্রিকান মানুষের আনাগোনা একটু বেশি মনে হল, যেভাবে আমি ফ্রান্সের প্যারিস নগরীতে দেখেছিলাম। ইতালিতে এসে গত কয়েক দিনের মধ্যে আমি কয়েকটি শব্দ-বাক্য শিখেছি এবং এগুলো প্রয়োগ করে ফলও পাচ্ছি ভালোই।

ইতালির পুলিশ আমার কাছে মনে হয়েছে মানবিক পুলিশ। একবার আমি আর আমার ভাই নাপোলি শহরের প্রধান স্টেশন পিয়াজ্জি গারিবাদি থেকে বাসে উঠে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। এখানে বাস সার্ভিসের সিস্টেম অন্যরকম। কার্ড পাঞ্চ করেও পারবেন অথবা ক্যাশ টাকা-কয়েন দিয়েও যেতে পারবেন। বাসে উঠার পর দেখলাম সবাই পাঞ্চ করছে, দু’একজন ক্যাশ বা কয়েন দিচ্ছে মেশিনে।

একজন আফ্রিকানকে দেখলাম কিছুই করলো না। আমি ভাইয়াকে বললাম, উনি তো কার্ড পাঞ্চ করল না, টাকাও দিল না। তাহলে উনার কী হবে? তিনি আমাকে যেটা বললেন সেটার সারমর্ম হচ্ছে এরকম- ইতালির বাস অথবা পুলিশ কর্তৃপক্ষ মনে করে যে, উনার যদি টাকা বা কয়েন থাকতো তিনি অবশ্যই বাস ভাড়া পরিশোধ করতেন। হয়তো ওনার কোনটাই নেই। তাই তিনি পরিশোধ করেননি।

ভ্রমণ কাহিনি: রোমের পথে পথে
বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। তিনি আমাকে আরও বললেন- এটা পোপের দেশ। এদেশে কেউ আসলে তাকে বিতাড়িত করা যাবে না। ইউরোপের কিছু কিছু দেশ আছে অতি-মানবিক। এখানে ধর্মের চেয়ে মানবতাবোধ অনেক উপরে। তার মধ্যে ইতালি অন্যতম, ওরা জাতিগতভাবে খুবই মানবিক। এজন্য বেশ কয়েক বছর আগে দলে দলে বিভিন্ন দেশ থেকে নৌকা-স্পিডবোট যোগে লোকেরা একটি উন্নত জীবনের আশায় এদেশে প্রবেশ করত।

যা হোক, রোমের রাস্তায় কিছু মানুষকে দেখলাম বিভিন্ন খেলনা, ফুল বিক্রি করছে। অনেকে আবার নিজের ক্রিয়েটিভিটি চিত্র অংকনের মাধ্যমে দেখাচ্ছে। কলসিয়ামের আশপাশে কিছু কিছু লোকের ক্রিয়েটিভিটি লেভেল দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে না, তাদের শৈল্পিক কার্যকলাপ দেখিয়ে কাজ করে খাবে।

ইউরোপের প্রায় সবগুলো পর্যটন নগরীতে, পর্যটকদের সুবিধার্থে কতগুলো বিশেষ বাস চলাচল করে বিভিন্ন প্যাকেজে। প্যাকেজের আওতায় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ১০ থেকে ১২টি স্থানে আপনার যেখানে খুশি সেখানে নামবেন আবার যেখানে খুশি সেখানে থেকে উঠবেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম অনেক বাংলাদেশি ভাই দাঁড়িয়ে আছে একসঙ্গে বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট এবং ক্যাপ মাথায় দিয়ে।

ওরা আসলে এখানে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ওর মধ্যে কেউ কেউ টুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করেন এবং টুরিস্ট বাসের টিকেট টিকেট বিক্রি করেন। এদের মধ্যে একজন ভাইকে দেখলাম আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে, নিজের পরিচয় দিলেন। তার নাম মহিউদ্দিন, বাড়ি চট্টগ্রামের মেহেদীবাগে। আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে উনি যে খুব খুশি হলেন তা তার চোখে-মুখে বুঝা যাচ্ছে।

আমাকে বললেন- ভাই, আমাদের তিন কালারের বাস সার্ভিস আছে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রুটে চলবে, তিনটি ভিন্ন প্যাকেজ, দামও আলাদা আলাদা। আমাদের তিনি সবচেয়ে ভালো প্যাকেজটি দিলেন, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র দেশ ভ্যাটিকান সিটিতেও নিয়ে যাবে। ৬ ইউরো দাম কম রাখলেন। আসলে দেশি ভাই-বোন পেলে ওরা অন্যদের চেয়ে দাম কম রাখতে পেরে আত্মতৃপ্তি পায়।

আমরা ঝটপট বাসে উঠে পড়লাম। দেখতে থাকলাম পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন ঐতিহ্যবাহী নগরী। নানা দেশের নানা ধরনের মানুষ রোমের পথে পথে হাঁটছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তুলছে। আমরাও মাঝে মাঝে বাস থেকে নেমে পড়ছি আর হেঁটে হেঁটে দেখছি রোম নগরীর প্রাচীন স্থাপনা। সে এক অদ্ভুত ভালো লাগা। মনে হচ্ছে আমরা সেই প্রাচীন যুগে ফিরে গিয়েছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com