মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩০ অপরাহ্ন

রোমাঞ্চে ঘেরা মেঘালয়

  • আপডেট সময় বুধবার, ২২ মে, ২০২৪

অ্যাড্রিনালিন রাশের জন্য মোক্ষম শব্দবন্ধ। তবে অ্যাডভেঞ্চার মানেই যে সেটি ডেয়ারিং হতে হবে, এই তত্ত্ব কিন্তু সর্বদা সত্য নয়! গত বছর এপ্রিল মাসে গোয়েচালা ট্রেকিংয়ের সময় এক অস্ট্রেলীয় সহযাত্রী শুনিয়েছিলেন, ‘একটি অতিপরিচিত রুট, যেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে আকছার যায় সক্কলে, সামান্য কিছু ইনোভেশন অ্যাড করে সেই ট্রিপটিকেই বানিয়ে ফেলা যায় আরও আকর্ষক!’ কথাটা গেঁথে গিয়েছিল মনের গভীরে। সেই এক্সপেরিমেন্টের জায়গা থেকেই হয়ে গেল প্ল্যানিং, এপ্রিল ২০১৭-তে আ বাইক ট্রিপ টু মেঘালয়! চার চাকা সম্বলিত লোহার খাঁচার পরিবর্তে দ্বিচক্রযানে সওয়ার হয়ে শিলং, চেরাপুঞ্জি, মওলিংনম, ডাউকি ঘুরে বেড়ানোটা যে কতটা অন্যরকম, কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে, সেটা কল্পনা করেই হার্টবিট চড়েছিল কয়েক ধাপ! বাইকিং, সঙ্গে কিছুটা হাইকিং, ককটেল প্ল্যান জমে দই! ডেয়ারিং? সুবিস্তৃত মাখন-মসৃণ রাস্তায় মোটরবাইক চালাতে তেমন একটা লাগে না। তবে বৈচিত্রের মোড়কে অ্যাডভেঞ্চারের থ্রিল পরতে-পরতে! ভয়ঙ্করতা একেবারেই যে নেই, বুকে হাত দিয়ে এতবড় মিথ্যেটা বলব না। তবে তার জন্য দায়ী তো আমরা নিজেরাই। সে গল্প ক্রমশ প্রকাশ্য…

তার আগে বরং সাবধানতার প্রসঙ্গে বলি। আমাদের উদ্দেশ্য যখন বাইক চড়ে মেঘালয় ঘোরা, তখন কলকাতা থেকে সেটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বাড়াবাড়ি করার কি খুব প্রয়োজন আছে? কলকাতা থেকে ট্রেনে গুয়াহাটি এবং তারপর দু’টি বাইকে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়লেই তো হল! ও বলা হয়নি, এই ট্রিপে আমাদের গ্রুপে সদস্য সংখ্যা চার, আসমানি নীল টি-শার্টে যাদের প্রত্যেকের বুকের উপর লেখা ‘অ্যালপাইনিস্টস’! ইন্টারনেট ঘাঁটতেই বেরিয়ে এল বেশ কয়েকটি এজেন্সির নাম, যারা গুয়াহাটিতে ভাড়ায় বাইক সাপ্লাই করে। তারপর তাদের রেট কমপেয়ার করে বেস্ট ডিল বেছে নিলেই অর্ধেক কাজ শেষ। একটা বিষয়ে একমত ছিলাম সকলেই, রয়্যাল এনফিল্ড ছাড়া এই ট্রিপে বাহন হিসেবে আর কোনও কিছুর কথা ভাববই না। সেই মতো এজেন্সির গ্যারাজ থেকে বেছে নিলাম দু’টি ৩৫০ সিসি-র বাইক। বাইকের দু’দিকে দু’টি কেরিয়ার লাগিয়ে চাপিয়ে দিলাম রুকস্যাক। আর তারপর গুয়াহাটির বিখ্যাত নাগা ফুড জয়েন্টে স্মোকড পর্ক ফ্রাই উইথ অখুনি সাঁটিয়ে স্টার্ট দিলাম বাইক, ওয়ে টু শিলং…

গুয়াহাটি থেকে শিলং, চার লেনের মসৃণ রাস্তা চলেছে এঁকেবেঁকে… যার মাঝবরাবর আছে ডিভাইডার। বাইক চালানোর জন্য এর চেয়ে আদর্শ ও নিরাপদ পথ আর হতেই পারে না! ফোটোসেশন, টি-ব্রেক সব ধরেও এই ১০০ কিলোমিটার পথ অনায়াসে অতিক্রান্ত হয় তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টায়! শিলং ঢোকার ১২-১৫ কিলোমিটার আগে বাইকে লাগাম লাগাতেই হবে। কারণ? উমিয়াম (বড়াপানি) লেকের অপূর্ব শোভা। লেকের বিস্তৃতি প্রায় ২২০ স্কোয়্যার কিলোমিটার! ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন, তাই উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে গেলাম বড়াপানির উপর সূর্যাস্তের নৈসর্গিকতাও! গোধুলিবেলায় লেকের সৌন্দর্য দু’চোখে মেখে ফের শুরু হল যাত্রা। শিলং শহরে যখন ঢুকলাম, সন্ধে নেমে এসেছে।

শরীর জুড়ে নেমেছে ক্লান্তি। উষ্ণতার পারদও নেমেছে বেশ কয়েক ধাপ। কিন্তু গেস্ট হাউজ়ে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে গরমা-গরম কফির কাপ হাতে পেতেই শরীর-মন দুই-ই চাঙ্গা! ‘গুরুবচন’ আগেই পেয়েছিলাম, শিলং শহরে সন্ধে সাতটার পরে হোটেল ছেড়ে বেরনো টুরিস্টদের জন্য নাকি মোটেই ‘সেফ’ নয়। কিন্তু কফির এমনই মহিমা, রাত আটটাতে বেরিয়ে পড়লাম ফের একবার। উদ্দেশ্য, শিলং শহরটা একটু ঘুরে দেখা। গুগ্‌ল বলে দিল, পুলিশ বাজার চত্ত্বরটাই তখন সবচেয়ে জমজমাট। জিপিএস অন করে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম দশ মিনিটের মধ্যেই। জায়গাটা আমাদের ধর্মতলার মিনি সংষ্করণ। নানারকম স্ট্রিট ফুড, বাহারি পোশাক-আশাকের দোকান, হোটেল, আইসক্রিম পার্লার… কী নেই সেখানে! পায়ে হেঁটে পুরো এলাকাটা ঘুরতে সময় লাগল মিনিট পঁচিশ। এবং তাতেই কিছুটা হলেও পাওয়া গেল শহরের হৃদয়স্পন্দন। ওখানেই নাগা চিকেন থালি দিয়ে রাতের খাবার সেরে ফিরলাম গেস্ট হাউজ়ে, বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।

ঘুম যখন ভাঙল, বাইরে তুমুল ঝড়! সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। হুড়মুড় করে উঠে ঘড়ি দেখলাম, সকাল সাড়ে আটটা! এদিকে ভোরবেলাতেই যাওয়ার কথা ছিল ইস্ট খাসি হিলসে, লাইটনাম ক্যানিয়ন দর্শনে। যে জায়গার সঙ্গে নাকি মিল আছে স্কটিশ হাইল্যান্ডসের। ব্রেড-অমলেটে ব্রেকফাস্ট সেরে, রেনকোটে মাথা থেকে পা ঢেকে স্টার্ট দিলাম বাইকে। শিলং শহর ছেড়ে বেরোতেই, বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ল কয়েকগুণ! ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে মিলিত হল ঠান্ডার কামড়! সে এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি তখন বিলাসিতা। যদিও রাস্তার দু’ধারে প্রকৃতির নিজের হাতে সাজানো ভ্যালি মনে করিয়ে দেবে সুইটজ়ারল্যান্ডের কিছু চেনা ক্যানভাস।

স্মিথ ভিলেজ পেরিয়ে লাইটনামের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছিল, ভারতবর্ষেই আছি! চোখের সামনে ভেসে উঠল ‘রক অন ২’-এর সেই দৃশ্য… এত বিস্তৃত ঘন সবুজ ক্যানিয়ন… জাস্ট আউট অফ দ্য ওয়র্ল্ড!

পরের দিন সকালে চেরাপুঞ্জি রওনা হওয়ার সময় প্রকৃতির মুড বদলে গিয়েছে ১৮০ ডিগ্রি! ঝলমলে আকাশ, মেঘ-রোদের লুকোচুরি, দেখলে কে বলবে, কাল এরা আমাদের কী কষ্টই না দিয়েছে? বরুণ দেবের কল্যাণে শিলং পিকে দাঁড়িয়ে শহরটাকে দেখলাম একদম অন্য রূপে! কিন্তু সেখান থেকে নেমে নোকালিকাই ফলসের দিকে মিনিট তিরিশ বাইক চালানোর পরেই পথ-ঘাট, পারিপার্শ্বিক সব কিছু ঢেকে যেতে লাগল ঘন মেঘের চাদরে। ১০ ফুট দূরের জিনিসও নজরে আসছে না তখন। প্রমাদ গুনলাম মনে মনে, এই রকম মেঘ-কুয়াশার প্রকোপ থাকলে ভারতবর্ষের উচ্চতম ওয়াটারফল (৩৪০ মিটার) দর্শন বোধহয় এযাত্রায় আর হবে না!

প্রকৃতির উপর তো কারও হাত নেই, অগত্যা সব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে এরকম একটা স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে দিয়ে দিনের বেলায় বাইকের হেডলাইট ও ডাবল ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে রাইডিংটাই উপভোগ করলাম পুরোদস্তুর। এবং কী আশ্চর্য, নোকালিকাই পৌঁছনোর মিনিট সাতেকের মধ্যেই মেঘের চাদর ক্রমশ সরতে শুরু করল জলপ্রপাতের উপর থেকে! মিনিট ১৫-২০-র মধ্যে দৃশ্যপট পুরোপুরি স্পষ্ট! পাহাড়ের উপরের সমতল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উত্তাল জলরাশি। মূল জলপ্রপাতের আশেপাশে ছোট-খাটো আরও অনেকগুলি জলপ্রপাত। লক্ষ করলাম, ঠিক উল্টো দিকে পাহাড়ের খাঁজে আটকে আছে দু’-তিনশো মিটার বিস্তৃত মেঘরাশি। স্থির!

আমরা যতক্ষণ ছিলাম ওখানে, সেই মেঘরাশিকে সরে যেতে দেখলাম না একটুও! এরকমও হয়? সাধারণত নীল আকাশে মেঘের চলাচল দেখতেই ভাল লাগে, কিন্তু তা যে পাহাড়ের কোলে স্থির ভাবে ঝুলে থেকেও এত উপভোগ্য হতে পারে, সেটা উপলব্ধি করলাম প্রথমবার। চেরাপুঞ্জিতে পৌঁছে রিসর্টে ঢোকার আগে দেখে এলাম সেভেন সিস্টারস ফলসও। সত্যি বলতে কী,  এই জায়গাটির নাম যতটা শুনেছিলাম, ভিউ ততটাও ভাল নয়। বরং এর ঠিক উল্টোদিকে বাংলাদেশের নদী-নালা-জনবসতির কিঞ্চিৎ দর্শন কিছুটা হলেও অন্যরকম অনুভূতি দেয়।

আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম অনুভূতি হল পরেরদিন ডাবল ডেকার রুটব্রিজ ও রেনবো ওয়াটারফল দেখতে গিয়ে। পুরোটাই পায়ে হেঁটে যেতে হয়, সবমিলিয়ে প্রায় সাত ঘণ্টার ট্রেকিং। তিরনা ভিলেজে বাইক রেখে সকাল সাড়ে ন’টায় শুরু হল হাঁটা। ১৯৭৫টি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে, খান দু’-এক হ্যাঙ্গিং ব্রিজ পেরিয়ে ঘণ্টা আড়াই পর গিয়ে পৌঁছলাম ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের কাছে। গাছের শেকড় পেঁচিয়ে তৈরি এই ব্রিজগুলি, একটির উপর (প্রায় ফুট ২০ ব্যবধানে) রয়েছে আর একটি। তাই এটি ডাবল ডেকার! তবে গোটা মেঘালয় জুড়ে এরকম রুট ব্রিজ রয়েছে আরও অজস্র।

যদিও এই ডাবল ডেকারের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। এখান থেকে আরও ঘণ্টাখানেক পায়ে হেঁটে বিস্তর পাহাড়ি ঝরনা ও নদী পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম রেনবো ওয়াটারফলের সামনে। নাম শুনেই আশা করি বুঝতে পারছেন, সারা বছর এই ওয়াটারফলের উপরে দেখা যায় রামধনু! যদিও আমাদের কপাল মন্দ। এত পথ পেরিয়ে যে রামধনু দেখার জন্য এলাম, মেঘলা আকাশের জন্য তা আর দেখা হল না। রোদ উঠলে তবে না তার ছটায় হবে রামধনু! দুঃখ যতটা না হল, তার চেয়েও বেশি আশঙ্কা তখন ক্রমশ গ্রাস করছে মনকে। কেন? আবার সাড়ে তিনঘণ্টা পায়ে হেঁটে ফেরাই তো নয়, তারপর ১৯৭৫টি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে তবে না পৌঁছব বাইকের সামনে! ব্যাপারটা ভাবতেই ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে।

বাইকের কাছে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ছ’টা। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইক স্টার্ট করে হেড লাইট জ্বালাতেই বুঝলাম, শুধু অন্ধকার নয়, প্রতিবন্ধকতা আরও জটিল! যার নাম কুয়াশা। এতটাই ঘন সেই কুয়াশা যে, ভিজ়িবিলিটি অলমোস্ট জ়িরো! কাজ করছে না গুগল ম্যাপও! পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেদিন যে কীভাবে রিসর্ট অবধি ফিরেছিলাম, তা ভেবে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় এখনও। অন্তত বার পাঁচেক বাইক থামিয়ে ভাবতে হয়েছিল, কোনদিকে খাদ আর রাস্তাটাই বা কোন দিকে!

প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়ানোর মজা বোধহয় এটাই, পরেরদিন সকালে আবার সব ঝকঝকে, তকতকে! ভাগ্যিস। কারণ সেদিন তো আমাদের বাইক চালাতে হত প্রায় ২১০ কিলোমিটার! চেরাপুঞ্জি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম মওলিংনম, এশিয়ার ক্লিনেস্ট ভিলেজ় সেটি। যদিও মনে হল, এই জায়গাটিও কিছুটা ওভারহাইপড! যা-ই হোক, সেখান থেকে ডাউকিতে পৌঁছে নৌকাবিহার, সবুজ জলে খানিক দাপাদাপি, কিছুটা এগিয়ে তামাভিল গিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার ছুঁয়ে আসা! আর তারপর? ঘরে ফেরার পালা…

বাইক চলেছে শিলংয়ের পথে, চোখের সামনে ছায়াছবির মতো সরে যাচ্ছে লাইটনামের সবুজ ক্যানভাস, নোকালিকাইয়ের জলরাশি, চেরাপুঞ্জির মেঘ… মনে-মনে আর একবার ঝালিয়ে নিলাম আমার প্রিয় মন্ত্র, ‘ওয়র্ক। সেভ। ট্র্যাভেল। রিপিট।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com