চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পার হতেই শুরু হয়েছে আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু রাস্তা। বুঝতে বাকি নেই, পার্বত্যাঞ্চলে ঢুকে পড়েছি। গুইমারা অঞ্চল। মানিকছড়ি উপজেলা। চট্টগ্রাম থেকে যেতে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার। পুরো জেলা তো পর্বত! শৈল জেলা।
আলুটিলা পাহাড়। দীঘিনালা পেরিয়ে রাঙ্গামাটির পাহাড়। তারপরই সাজেকভ্যালি। রুইলুই পাড়ার ডানদিকে মিজোরামের পর্বতশ্রেণি। লুসাই পাহাড়ও আছে। সাজেক আর্মিক্যাম্প ছাড়িয়ে এলাকার সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া কংলাক। মেঘ আটকে যায় পাহাড়ভাঁজে। লালপাহাড়ের দেশ। সকাল-দুপুর-রাতে বৈচিত্র্যময় দৃশ্যের অবতারণা হয় সাজেকে।
মেঘ বলে যাব যাব
রুইলুই পাড়া, কংলাক পাহাড়চূড়া বা সাজেকের অনেক স্থান থেকে মেঘবালিকাদের উড়তে দেখা যায়। আমরা ওপরে আর নিচে মেঘ ভেসে যায়। মেঘ বলে যাব যাব, আমরা বলি আরও থাক।
ভাসতে থাকা মেঘরা বলে পেছনের দিকে আছে আরও। সূর্যের ঝলমলে আলো। মেঘের প্রতিফলিত আলো এক চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করে। লাল-সাদা নানা ফুল ফুটে আছে পুরো রুইলুই পাড়ায়। রিসোর্ট আর মেইন রোডের সঙ্গেই। এসবের মধ্যেই শুভ্রসাদা মেঘের সারি! এক মোহনীয় দৃশ্য! চম্বুকময়তার আবেশীয় পরিবেশ কখনও ভুলে যাওয়ার নয়!
সকালের রুইলুই
রোজ সকালে বা ভোরবেলায় রুইলুই পাড়াময় মেঘ ভাসে। সড়ক থেকে ফাঁক গলিয়ে মেঘ দেখাটা আসলেই মজাদার। মেঘবালিকারা মাঝরাত থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত প্রচণ্ড রকমের খেলা খেলে। ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে চলে যায় কেউ কেউ। দুপুরে পাহাড়/উপত্যকায় সাদা মেঘের মধ্যে সবুজ খেলা করে। বিকালে সবুজের ওপর সাদা ধোঁয়া উড়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ।
বিকালের রুইলুই
বিকালবেলা পাহাড়ের সবুজ অংশ বের হয়। খণ্ড খণ্ড মেঘবালিকা উড়ে যায়। রাস্তার ধারে বা রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে এসব দৃশ্য অন্যসব চিন্তাকে তাড়িয়ে দেবেই। ক্ষণিক ক্ষণিক মনে হবে, মেঘ ভাসে না আমরা ভাসি। আমরাই মনে হয়, সাদা মেঘের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি! চা-কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ ডাক- আমার মোটরবাইকার কাম গাইডের! স্যার, হ্যালিপ্যাডে উঠি? সন্ধ্যারাতের দৃশ্য বড়ই চমৎকার! তাছাড়া আজ তো পূর্ণিমা রাত। সোনায় সোহাগা! ওহ, ‘তাই তো, তাই তো’ করতে করতে রাস্তার পাশের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সন্ধ্যায় রুইলুই
এরপর হ্যালিপ্যাডে উঠলাম। আরও লোকজন আছে সেখানে। প্রেমিক-প্রেমিকাও আছে। যুগলবন্দিও কয়েকজনকে দেখলাম। বাচ্চারা হই-হুল্লোড় করছে। তারপরও নির্জন-নিরিবিলি। পাহাড় ঘুমায়, চাঁদ পাহাড়া দিচ্ছে। রুইলুই পাড়ায় আলো ও সুরের খেলা চলছে। এখানেও দলছুট তরুণদের কণ্ঠ ভাসে। রোমান্টিক গানে। আনমনেই আমি কিছু কিছু অংশে কণ্ঠ মিলিয়ে দিলাম। আজ দেখার কেউ নেই। আজ আমি অফিসার না! আমিও তরুণ। আমি দলছুটও। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাদের সঙ্গে শুরু করলাম ‘লাল পাহাড়ের দেশে যায়, রাঙামাটির দেশে যায়… এক্কেবারে মানাইছে তারে, এক্কেবারে মানাইছে তারে…’।
রাতের রুইলুই পাড়া
রাতে পুরো রুইলুই পাড়া জেগে ওঠে। হ্যালিপ্যাডে তরুণ-তরুণী এবং পর্যটকদের জীবন্ত আড্ডা। হঠাৎই ভেসে এল সুর, ‘লাল পাহাড়ের দেশে যায়… এক্কেবারে মানাইছে তারে…’।
উদ্যমী তরুণদের সুর মায়া সৃষ্টি করে পাহাড়ে। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ সামনে বা পেছনে রেখে সেলফি/ছবি তোলার মজাটাই আলাদা। লুসাই আর সাজেকের বিভিন্ন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মিটমিট আলো। কী অপরূপ! যেন আলো গ্লাসে তৈরি। রুইলুই পাড়াকে মনে হয়, স্বচ্ছ আয়নার ওপর আলোর খেলা। হ্যালিপ্যাড থেকে অভিভূত হতে হয় এ নান্দনিক দৃশ্য দেখে। আমি তো রীতিমতো অবাকই হয়েছিলাম। কী দারুণ দেখতে! চোখগুলো (আলোর চমক/লাইট) টানা টানা…।
রুইলুই পাড়ায় আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। পেছনেই লুসাই পাহাড়ের পাদদেশ। মেঘের ওড়াউড়ি। সবুজের মধ্যে সাদা ভেলা। পাহাড়ি শিশুরা খেলা করছে। ‘পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার হার বেড়ে গেছে’ তারই প্রমাণ মেলে। বাচ্চারাও আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। বাংলাও বুঝতে পারছে।
পাহাড় থেকে পাহাড় দেখা
কংলাক পাহাড় থেকে সাজেকভ্যালি, মিজোরাম পাহাড়শ্রেণি, লুসাই পাহাড় দেখতে চমৎকার। বিকালবেলায় অনেকাংশই পরিষ্কার। বিশেষ করে সাজেকভ্যালি পরিষ্কার দেখা যায়। লুসাই বা মিজোরামের পাহাড়ে মেঘের ভেলা।
পাহাড়ে আছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। বাড়িঘরেও এসেছে বৈচিত্র্য ও আধুনিকতার ছোঁয়া। জনসমাগমেও আসছে অনেক উপজাতি। বাঙালি-উপজাতির বৈষম্যও কমছে ধীরে ধীরে। সাজেকের এলাকা বৈচিত্র্যে ভরপুর। আবেশীয় দৃশ্যের ঘনঘন পরিবর্তন। সকাল-দুপুর-বিকালে ভিন্ন দৃশ্য! রাতে ও ভোরে অন্যরকম ভালোলাগার ছোঁয়া! সবসময়ে বৈচিত্র্যময় চম্বুকীয় আবেশতা!
যাতায়াত
চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে খাগড়াছড়িগামী বাস পাবেন। সময় লাগবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। বায়েজিদ বোস্তামি থেকে শান্তি পরিবহনে গেলে সময় কম লাগবে। আরামদায়কও হবে। ভাড়া একটু বেশি পড়বে। ২০০ টাকা। এছাড়া ঢাকার গাবতলী-সায়েদাবাদ থেকে সকাল ও রাতে খাগড়াছড়িগামী বিভিন্ন পরিবহন পাবেন। ভাড়া ৫৫০ টাকা। ট্রেনে চট্টগ্রামে গিয়ে তারপর বাসে খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। এরপর চান্দের গাড়িতে রুইলুই পাড়া। দূরত্ব প্রায় ৫০ কিমি.।
চান্দের গাড়ি
রুইলুই পাড়া বা সাজেকে যেতে হলে স্থানীয় চান্দের গাড়িতে যেতে হবে। ১০-১৫ জনের ব্যবস্থা এক গাড়িতে। ভাড়া এক দিন-রাতের জন্য ৮০০০ টাকা। ৩-৪ জনের মাহেন্দ্র ভাড়া ৪০০০ টাকা। একজন বা দুজন থাকলে মোটরবাইকে দু’হাজার টাকা নেবে। সবক্ষেত্রে রিজার্ভ করতে হয় এবং সময়ভেদে ভাড়া কমবেশি হয়। চান্দের গাড়ি খাগড়াছড়ি বাসস্টেশনের কাছে পাওয়া যাবে। মাহেন্দ্র/বাইক দীঘিনালায়ও পাওয়া যাবে। খাগড়াছড়ি বা দীঘিনালায় থাকা ও খাওয়ার চমৎকার সব ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন বাজেটের ব্যবস্থায় ইচ্ছামতো পছন্দ করতে পারবেন।
যাতায়াতের সময়সূচি
রুইলুই পাড়া যেতে হলে বাঘাইহাট আর্মিক্যাম্প থেকে নাম এন্ট্রি করতে হবে। গাড়িও এন্ট্রি করতে হবে। পর্যটকরা দিনে দু’বার সাজেক এলাকার দিকে যেতে পারবেন। সকাল ১০টা ও বেলা ৩টায় বাঘাইহাট ক্যাম্প থেকে একত্রে যাত্রা করতে হবে। ফেরার সময় রুইলুই পাড়ায় উল্লেখিত একই সময়ে এন্ট্রি দেখিয়ে যাত্রা শুরু হবে। যাওয়া-আসা উভয়ক্ষেত্রে মাসালং আর্মিক্যাম্পে রিচেকিং হবে। সাজেকগামী বা দীঘিনালাগামী উভয় পর্যটকরা মাসালংয়ে একত্রিত হন। মিলনমেলা বলা যায়। উভয়ক্ষেত্রে পুলিশ স্কর্টের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মিরা মোড়ে মোড়ে থাকেন। দারুণ লাগে এ অনুভূতি।
স্পেশাল
পাহাড়ি খাবার খাওয়া যাবে এ পর্যটন এলাকায়। ব্যাম্বু টি বা পাহাড়ি মুরগির মাংসের স্বাদ ভালোই লাগে। এ এলাকা ব্যাম্বু চিকেনের সুবাসে ভরপুর। পেঁপে খেতে দারুণ মজা। নরম আখের রস সস্তায় পাবেন। পাহাড়ি আদিবাসীদের নৃত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুব ভালো লাগে। অর্ডার দিয়ে এসব খাবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। কলার স্বাদ নিতে ভুল করা যাবে না। পুরো এলাকায় মাঝে মধ্যে পথের ধারে পাহাড়ি ফলমূল বা জিনিসের পসরা বসায় পাহাড়ি মেয়েরা। রুইলুই পাড়ায় লুসাই মেয়ের হাতের ‘ব্যাম্বু টি’ খেতে ভিড় থাকে। রাতের বেলায় বেশি ভিড় থাকে।
লুসাই গ্রাম
ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম সাজেকে অবস্থিত একটি মডেল গ্রাম। শতবছরের পুরনো লুসাইদের সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে কাছ থেকে উপভোগ করা যায়। চাইলেই মেঘ-পাহাড়ের মাঝে এমন জুম ঘরে রাত্রিযাপন, ঘরের বারান্দায় বসে তারা দেখতে পারেন। সাজেকের একমাত্র ‘ট্রি হাউস’ রয়েছে লুসাই গ্রামে। রাত্রিযাপনের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়া, রাতে বারবিকিউ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ রয়েছে আরও অনেক আয়োজন। বুকিং : ০১৫৩৩-০৯৯২১৩, ০১৬১১-০৮৬৫১৩।
সতর্কতা
পাহাড়িদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের। আর্মিক্যাম্প এলাকায় ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে। অতিরিক্ত মোবাইল, ক্যামেরা, ব্যাটারি বা চার্জার ব্যাংক নিতে হবে। চার্জ দেয়ার সুবিধার্থে সীমিত সময়ের জন্য কটেজ বা হোটলে জেনারেটর চালু করেন সংশ্লিষ্ট আবাসিক কর্তৃপক্ষ।
থাকা ও খাওয়া
থাকা ও খাওয়ার জন্য রুইলুই পাড়ায় রিসোর্ট আছে। লুসাইগ্রামে ৩-৪ হাজার টাকায় গাছবাড়িতে থাকতে পারবেন। লুসাই পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ অরণ্যঘেরা কটেজে থাকার অনুভূতিই আলাদা। মেঘের মধ্যেই থাকা যাবে। মেঘ দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে, ধরা যাবে! আদিবাসীদের কুটিরেও থাকতে পারবেন। দামদর ঠিক করে কটেজ-কুটিরে থাকা যাবে। ছুটির দিনে ও পিক সিজনে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো। বিভিন্ন দাম-মানের রিসোর্ট বা কটেজ রয়েছে পুরো এলাকায়।
রাতের রুইলুই পাড়া। টুকটুকে লাল ফুল, টিয়া-রঙের ঝকঝকে কলাপাতার ফাঁকে মেঘবালিকারা। মোহিনীয় দৃশ্য। বাঁশের চা ও পাহাড়ি মোরগের গোশত। লুসাই মেয়ের হাতে চায়ের স্বাদ অনেক দিনই মনে পড়বে। গাছবাড়িতে একদিন থাকলে ও কালচারাল প্রোগ্রাম ও উপজাতীয় খাবার অনেক দিন মনে থাকবে।