বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৪ পূর্বাহ্ন

যেভাবে ৭ ব্যাংক দখল করেছিল এস আলম পরিবার

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪

ব্যাংক কোম্পানি আইনে ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা নজিরবিহীনভাবে সাতটি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম একটি দায়িত্ব হলো গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পরিবারকে সুবিধা দিতে সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারকে একাধিক ব্যাংক দখল ও বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করেনি।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা নজিরবিহীনভাবে সাতটি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়। আর এই অসাধ্য কাজটি সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারণে। মূলত বিশেষ অনুমতি দিয়ে এই পরিবারকে সহায়তা করেছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এখানে প্রথম উদাহরণ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের কথা বলা যায়। বেসরকারি ব্যাংকটিতে তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল। অথচ আইন বলছে, একটি ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ারের সীমা হবে ১০ শতাংশ। কিন্তু সেই আইন না মেনেই এই পরিবার ইসলামী ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ার দখল করে। এতে সাইফুল আলমের স্বজনরা ব্যাংকটি থেকে অনেক কম বিনিয়োগ করেও ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে নথিতে দেখা গেছে। যদিও এই ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নথির তথ্যের তিনগুণের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাইফুল আলমের পরিবার বাংলাদেশের একমাত্র পরিবার, যে পরিবারের সকল সদস্য ছাড়াও কিছু আত্মীয় একাধিক ব্যাংকের বোর্ডে বসে ছিলেন। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনজরে এই পরিবারের জন্য নিয়ম শিথিল করা হয়। ফলে তারা বেশ চতুর কৌশলে ব্যাংকগুলোর শেয়ার দখল করে নেয়।

সাধারণত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো একটি পরিবারকে এভাবে সুযোগ দিলে সেই দেশের ব্যাংকসহ পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

এজন্য বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের কার্যকলাপকে বারবার ‘অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক’ বলে সমালোচনা করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর ওপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ কমানোর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্ধারকরা বিশেষজ্ঞদের এই পরামর্শে কর্ণপাত করেননি। তাই ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা অন্ধের মতো সাইফুল আলম ও তার পরিবারকে সুযোগ দিয়েছে। এতে কয়েকটি ব্যাংকের ওপর এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণ দিনের পর দিন জোরালো হয়।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়। এর আগ পর্যন্ত সাইফুল আলমের পরিবারের সবাই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।

সাইফুল আলম ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন একজন পরিচালক ছিলেন। তাদের ছেলে আহসানুল আলম, মেয়ে মাইমুনা খানম ও জামাতা বেলাল আহমেদ যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। সাইফুল আলমের ভাই, বোনসহ অন্যান্য আত্মীয়রাও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ডে ছিলেন।

যদিও ব্যাংক আইন বলছে, একটি ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের মালিকানা থাকা কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনতে পারবেন না। একই নিয়ম ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ও কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হবে।

অথচ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ারের মালিকানা থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেন সাইফুল আলম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন, সাইফুল আলমের পরিবারের এ কার্যক্রম আইনতভাবে বন্ধ করার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাংক তা করেনি। বরং তাদের কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দিয়েছে।

আইনে বলা হয়েছে, একটি পরিবারের তিনজনের বেশি সদস্য ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। এছাড়া একটি পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না।

কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছাড়াও সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্য ও প্রতিষ্ঠানগুলো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২২ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৮ শতাংশ ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল।

এছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও নর্দার্ন ইনস্যুরেন্সে পাঁচ শতাংশ করে এবং আভিভা ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ব্যাংকে ৭০ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে তাদের।

তবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডিং তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে ব্যাংকটির মালিকানা দাবি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের (বিএএসএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলোর ওপর সাইফুল আলমের পরিবারের এই নিয়ন্ত্রণ ‘অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘আইনসম্মত’ নয়।

এস আলম পরিবার ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নেওয়া ঋণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধে আইনি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এস আলমকে তাদের স্বার্থে ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

তার ভাষ্য, ‘ব্যাংকিং ব্যবসা একেবারেই আলাদা। কারণ আমানতকারীরাই হচ্ছেন ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মালিক।’

ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি এস আলমের স্বজনদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

অন্যদিকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেখিয়েছে।

অন্য ব্যাংকগুলোও এ দুই ব্যাংকের দেখানো পথেই পা ফেলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এস আলমের আত্মীয়দের দেওয়া ঋণ নথিতে উল্লেখ করা তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে।

এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।’

একটি ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, অনেক পরিচালক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বছরের পর বছর ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এভাবে তারা ঋণখেলাপি হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। তাই পরিচালকদের ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে হবে, যেন তারা খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে না পারে।

নথি বলছে, ব্যাংকের বোর্ডে এস আলম পরিবার কীভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাদের দখলে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ইয়োলো জোনে আছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ‘ভালো’ ও ‘ভঙ্গুর’ এর মাঝখানে আছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘একটি পরিবার কীভাবে ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণ করে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এস আলম পরিবার।’

তিনি বলেন, ‘এজন্য ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দায়বদ্ধ। এছাড়া সরকার আইন সংশোধন করে এস আলমকে ব্যাংকগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে।’

বিশ্লেষকরা আপত্তি তোলা সত্ত্বেও কোনো ব্যাংকের বোর্ডে একটি পরিবারের সদস্যদের পরিচালক হওয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে জাতীয় সংসদ। প্রথমে সেই সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে চার করা হয়। অবশ্য পরে চাপের মুখে কমিয়ে তিন করা হয়। এখানেই শেষ নয়, একজন পরিচালককে ১২ বছর বোর্ডে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়

ফাহমিদা খাতুন মন্তব্য করেন, ‘এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক।’

যখন একটি পরিবারের একাধিক সদস্য ব্যাংকের বোর্ডে থাকেন, তখন তারা তাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা কোম্পানিকে সুবিধা দিতে বোর্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক কম শেয়ারের পরিচালকরাও এ ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন।

যেমন ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলমের স্বজনরা ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পরিশোধিত মূলধনে তাদের অংশ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এতে বোঝা যায় ব্যাংকে তাদের বিনিয়োগের তুলনায় লাভ অনেক বেশি।’

এই অর্থনীতিবিদ আইনটি আরও সংশোধনের পরামর্শ দেন। তার ভাষ্য, ‘আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি পরিবারের মাত্র একজন সদস্যকে নিয়োগের সুযোগ দিতে হবে এবং একজন পরিচালকের মেয়াদ ছয় বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা এস আলম পরিবারকে এতগুলো ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘এই পরিবারটি যখন ব্যাংকগুলো দখল করছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করেছিল?’

‘বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল এই পরিবারকে থামিয়ে দেওয়া,’ বলেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে সাইফুল আলমকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিল দ্য ডেইলি স্টার, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর পাঠাননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাই তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com