বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৪ অপরাহ্ন
Uncategorized

যে সব কারণে বাতিল হতে পারে আপনার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যারা অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা কিংবা কর্ম উপলক্ষে আসেন, তাদের প্রায় সবারই আশা থাকে এদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করা। প্রতিটি মানুষের কাছেই তার নিজের মাতৃভূমি অনেক প্রিয়। নিজ শৈশবের স্মৃতি, স্বজনদের নৈকট্য কিংবা আজন্ম পরিচিত সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, এসব বিষয় সবাইকেই নষ্টালজিক করে তুলে। তবুও জীবনের নানা বাস্তবতায় মানুষ দেশান্তরী হয়, অন্য কোন দেশকে নিজের দেশ হিসেবে আপন করে নেয়। এসব কারণের মাঝে কখনো থাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুশিক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার আকাংখা। আবার কখনো অনেকেই বাধ্য হয় দেশত্যাগ করতে, যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে নিজের জীবন বাঁচাতে।

যে কারণেই একজন অভিবাসী মানুষ অস্ট্রেলিয়াকে তার নিজের দেশ হিসেবে বরণ করে নিতে ইচ্ছুক হোন না কেন, এই পথযাত্রা সাধারণত খুব সহজ হয়না। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন হলো পেশাগত দক্ষতা নির্ভর। সুতরাং সংশ্লিষ্ট পেশায় যোগ্যতা প্রমাণ করার পর একজন অভিবাসীকে এদেশে আসতে হয়, বসবাস করতে হয় এবং কাজ করতে হয়। অভিবাসনের আইন ও নীতিমালা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তবে নাগরিকত্ব অর্জনের মৌলিক ধাপগুলো একই রয়েছে এখনো।

সুতরাং প্রথমে ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর একজন অভিবাসী নির্দিষ্ট একটি সময়কাল কাজ ও বসবাস করার পর এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে থাকার আবেদন করতে পারেন। এ পর্যায়টি পারমানেন্ট রেসিডেন্সি বা পিআর হিসেবে পরিচিত। একজন মানুষ যখন অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে থাকার অনুমতি পান, তখনও তিনি এদেশের নাগরিক হয়ে উঠেননি। বরং স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে থাকার অনুমতি পাওয়ার পর তিনি বেশ কিছু নাগরিক সুযোগ ‍সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে তখনও তিনি একজন বিদেশী নাগরিক হিসেবেই এদেশে বসবাস করছেন।

এরপর আরো কিছু শর্তাবলী পূরণ করার পর এবং নির্দিষ্ট আরো একটি মেয়াদ এদেশে অতিবাহিত হওয়ার পরই একজন স্থায়ী বাসিন্দা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারেন। এ সময় একটি নাগরিকত্ব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় এবং পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি এদেশের পাসপোর্টও পেয়ে থাকেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একজন অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ভ্রমণের জন্য।

এ দীর্ঘ যাত্রায় প্রতিটি মানুষেরই অনেক ব্যক্তিগত সংগ্রাম থাকে, অনেক তীতিক্ষা থাকে। এতকিছুর পর যখন কোন একজন মানুষ অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হতে পারেন, তখন অনেকেই মনে করেন এই নাগরিকত্ব স্থায়ী একটি বিষয়। একবার সিটিজেন বা নাগরিক হয়ে যাওয়ার পর তা হয়তো আর কখনো বাতিল হবে না।

কিন্তু এই ধারণা যে সঠিক নয় তা সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার মতোই আরেকটি উন্নত দেশ ব্রিটেনের এক নাগরিকের সাম্প্রতিক এক ঘটনায়। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হয়ে বেশ কিছু বছর আগে পালিয়ে সিরিয়া গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিসের সাথে। সেখানে তিনি আইসিসের সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘আইসিস বঁধু’ হিসেবেও কুখ্যাতি পেয়েছেন। সম্প্রতি সিরিয়ায় আইসিসের পরাজয়ের পর শামীমা ব্রিটেনে ফিরতে চাইলে দেশটি তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে বলে জানায় এবং তাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে বাংলাদেশী বাবা-মায়ের সন্তান হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রিটেনে হওয়ার কারণে সে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানেনা। বাংলাদেশও তার জঙ্গী অভিযুক্ততার কারণে তাকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। এই দোলাচলের মাঝখানে পড়ে শামীমা এখন সিরিয়া থেকে পালিয়ে তুরস্কের এক শরণার্থী শিবিরে ভাসমান জীবনযাপন করছে।

শামীমার এই ঘটনা বর্তমান বিশ্বে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইনের সদা পরিবর্তনশীল অবস্থার একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অন্তত পাঁচটি কারণে একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের নাগরিকত্বও বাতিল হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মৌলিক শর্তটি হলো যদি নাগরিকত্ব বাতিলের কারণটি বাস্তবে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে এই নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য ঐ নাগরিকের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকতে হবে। অর্থ্যাৎ তাকে অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি অন্য আরেকটি দেশেরও নাগরিক হতে হবে। কারণ, কেউ যদি শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হয় এবং তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, সেক্ষেত্রে ঐ মানুষটি একজন দেশবিহীন মানুষ বা স্টেটলেস পার্সনে পরিণত হতে পারে যা অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুমোদন করেনা।

অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইন প্রবর্তন হয়েছিলো ১৯৪৮ সালে। এ বছরের শুরুতে ডিপার্টমেন্ট অফ হোম এফেয়ার্সের একজন মুখপাত্রের প্রদত্ত বিবৃতিতে জানা যায়, এরপর থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৫০ জন মানুষের অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। এদের মাঝে ৭ জনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে ২০১৫ সালে প্রবর্তিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের আওতায়। এ আইনে জানুয়ারী মাসে একসাথে ছয়জনের নাগরিকত্ব বাতিলের ঘটনা উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এই হিসেবে প্রকাশ করেন।

সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আলোচনায় এগিয়ে থাকলেও নাগরিকত্ব বাতিলের অন্য কারণগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্য একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নিজ থেকেই তার নিজের নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য আবেদন জানাতে পারেন। তবে চাইলেই যে তা বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এমনটিও নয়। বরং তাকে প্রমাণ করতে হবে যে তার অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব আছে, এবং সেক্ষেত্রে হোম এফেয়ার্স বা স্বরাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রীই এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।

নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে সাধারণত যে কারণটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে তা হলো নাগরিকত্ব অর্জনের সাথে কোন অপরাধ বা প্রতারণার জড়িত হওয়ার বিষয়টি। উদাহরণস্বরুপ, আপনি যদি আবেদন করার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব অর্জন করেন এবং ভবিষ্যতে কোন সময় যদি প্রমাণিত হয় যে এই আবেদন করার ক্ষেত্রে আপনি কোন মিথ্যা কিংবা প্রতারণামূলক তথ্য প্রদান করেছিলেন তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনার নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারবেন। নাগরিকত্বের আবেদনপত্রে ভুল তথ্য দেয়া কিংবা পূর্বের কোন মারাত্মক অপরাধের ঘটনা গোপন রাখলেও এমনটি ঘটতে পারে। অর্থ্যাৎ, আপনার নাগরিকত্বের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যদি আপনি সরকারকে সঠিক এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পুরোপুরি সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে এটাই হতে পারে আপনার নাগরিকত্ব বাতিলের কারণ।

এছাড়াও নাগরিকত্ব বাতিলের বিশেষ আরেকটি ক্ষেত্র হলো, বিশেষ কোন বিবেচনায় যখন কাউকে এদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয় তখন সেই ব্যক্তিটি যদি ঐ বিশেষ কারণটির শর্তাবলী পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার সেই নাগরিকত্ব বাতিল হতে পারে। এসব ভিসা ও নাগরিকত্ব সাধারণত দেয়া হয় যখন কেউ দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়াতে বিশেষ কোন অবদান রাখে। উদাহরণস্বরুপ, পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত ক্রিকেট খেলোয়াড় ফাওয়াদ আহমেদকে এদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে যেন তিনি এদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে অংশ নিতে পারেন।

অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব বাতিলের চতুর্থ ক্ষেত্র হলো কোন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক যদি তার নাগরিকত্ব হারায় তাহলে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের নাগরিকত্বও একইসাথে বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এক্ষেত্রে পঞ্চম এবং সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত কারণটি হলো, কোন নাগরিক যদি এমন কোন কাজ করে যাতে করে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আনুগত্যের খেলাপ হয়। একজন নাগরিককে তার দেশের প্রতি অনুগত হতে হয়। ২০০৭ সালে প্রবর্তিত সেকশন ৩৫ আইন অনুযায়ী, কোন নাগরিকের কর্মকান্ড যখন এই আনুগত্যের পরিপন্থী প্রমাণিত হয় তখন তার নাগরিকত্ব বাতিল

জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হওয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়িত কোন প্রতিপক্ষের হয়ে সরাসরি যুদ্ধ করা, অথবা যুদ্ধরত কোন পক্ষকে কোন ধরণের সেবা প্রদান করা, অথবা আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এই আনুগত্যের খেলাপ সাধিত হয়।

আইনের এই ধারাটির আওতায় জঙ্গিবাদ ছাড়াও আরো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বিরোধী কোন কর্মকান্ডকেও বৃহৎ পরিসরে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের পরিপন্থী বিবেচনার সুযোগ আছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, বিভিন্ন ধরণের মারাত্বক অপরাধমূলক কর্মকান্ডকেও রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বিরোধী হিসেবে নেয়া যেতে পারে। নাগরিকত্ব বিষয়ক আইনী পরিধি এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ডের আইনী পরিধির এই সম্ভাব্য মিশ্রণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বিষয়টি পরিস্কার করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com