বিষয়টি নিয়ে এতোদিন কানাঘুষা ছিল, কূটনৈতিক মহলে আলাপ-আলোচনা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সংবাদ সম্মেলনে তার প্রকাশ্য করলেন। প্রসঙ্গ সেন্টমার্টিন; প্রধানমন্ত্রী আজ সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার বলেছেন, সেন্টমার্টিন বিক্রি করে বা লিজ দিয়ে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান না। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতায় থাকার কোনো ইচ্ছে তার নাই। তিনি এটি-ও বলেছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড যুদ্ধ করার জন্য, অন্য কোনো দেশে আক্রমণ করার জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। এটি আওয়ামী লীগের নীতিগত অবস্থান। আর পাশাপাশি তিনি বিএনপি’র নাম উচ্চারণ না করে- তাদের সমালোচনা করে বলেন, তারা কি সেন্টমার্টিন বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চায়?
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের বিষয়টিও উত্থাপন করেন ওই সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। সেই সময় যদি আওয়ামী লীগ গ্যাস বিক্রিতে রাজী হতো- তাহলে আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় থাকতো বলে প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখ করেছেন। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে সেন্টমার্টিন চায় এবং সে জন্যই যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ইত্যাদি নিয়ে এতো কথাবার্তা বলছে- তা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সেন্টমার্টিন চায়?
এই উপমহাদেশ এখন পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতার লড়াই চলছে, চলছে নানা মেরুকরণ। যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাটি করতে পারে, সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত সহজ হবে। আর এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন যেকোনো মূল্যে সেন্টমার্টিন দখল করতে চায়। এটি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আজকের আগ্রহ- এমনটি নয়। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নিয়ে দর কষাকষি করছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের পতন শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে সেন্টমার্টিনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে এতোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র দাপট ছিল। কিন্তু সেই মধ্যপ্রাচ্য এখন চীন প্রায় দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সৌদি আরব, ইরান বৈঠক করছে- যে ইরানের উপর দীর্ঘদিন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সিরিয়া আরব লীগের সম্মেলনে দীর্ঘদিন পর যোগ দিতে পেরেছে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটছে। এই গৃহযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনেই পরিচালিত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে এখন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কিছুই করণীয় নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাপট মুখ থুবরে পড়েছে চীনের আর্থিক ক্ষমতার কাছে। একই অবস্থা আফ্রিকার দেশগুলোতেও। সেখানে আস্তে আস্তে চীনের নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চীন চোখ রাঙাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো দেশেই এখন চীনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল- এখন চীনের সঙ্গেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ শূন্য হয়ে গেছে।
যে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত অনুগত, বাধ্যগত ছিল। তারাও এখন চীন নির্ভর। ধুকতে থাকা অর্থনীতিতে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নয় বরং চীনকে প্রধান মিত্র হিসেবে ভাবছে। ভারত ছাড়া এই উপমহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেউ নেই। কিন্তু ভারতও বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তার নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে, নিজস্ব একটা কূটনীতি আছে। ভারত যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখছে, তেমনি রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, রাশিয়া-চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করছে। এক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করণীয় নেই। আর তাই এই অঞ্চলের সামরিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্য রাখার জন্য কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্যই সব হারিয়ে সেন্টমার্টিনের দিকে মনোযোগ দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেন্টমার্টিন এখন জন্য গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি।