অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আরেকটি বড় পদক্ষেপ নিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, দেশটির সংসদে একটি নতুন ‘অবৈধ অভিবাসন বিল’ পেশ করা হয়েছে।
এই আইনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইংলিশ চ্যানেল জুড়ে আসা ছোট নৌকায় এবং অন্যান্য সম্ভাব্য অভিবাসন রুট দিয়ে আসা সব অনিয়মিত অভিবাসীকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের জন্য ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হবে।
অভিবাসীদের আশ্রয় কাঠামোতে প্রবেশ করার পরিবর্তে ফৌজদারি আইনের অধীন রাখা হবে। যা তাদের আটক এবং তাদের নিজ দেশে বা নিরাপদ তৃতীয় দেশে পাঠানো হবে এবং যুক্তরাজ্যে পুনরায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করবে।
সরকার বলছে, নতুন বিলটি ২০২১ সালে পাস হওয়া জাতীয়তা এবং সীমানা আইনের আওতার বাইরে থাকা অভিবাসীদের বাধা দেবে। এর মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শিপিং রুট জুড়ে ছোট নৌকায় ভ্রমণ করা পাচারকারীদের বাধা দেয়া হবে।
আইনি সীমানার ঊর্ধ্বে
প্রস্তাবিত আইনটি উপস্থাপনের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান টুইটারে বলেন, “যদি আপনি এখানে (যুক্তরাজ্য) অবৈধভাবে আসেন তবে আর থাকতে পারবেন না।”
ব্র্যাভারম্যান আরও বলেন, ‘
এই আইন নিয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জের জন্য আমরা প্রস্তুত।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, “নতুন আইনটি যুক্তরাজ্যের সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনবে।”
সীমানা নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্রেক্সিট চুক্তির মূল অঙ্গীকার৷ অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলা, সুনাকের প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি।
বিলটি উত্থাপনের আগে সমালোচকরা বলছেন, আগের পরিকল্পনাটিও অকার্যকর ছিল। এটি সম্ভবত যুক্তরাজ্যের সরকারগুলোর ধারাবাহিক অসম্পূর্ণ অভিবাসন অঙ্গীকারগুলোর সর্বশেষ উদ্যোগ হতে পারে।
আন্তজার্তিক এনজিও ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির নির্বাহী পরিচালক লরা কির্ক-স্মিথ বলেছেন,
এটি ছোট নৌকাগুলোর চ্যানেল পাড়ি দেওয়া বন্ধ করবে না। বরং নৌকায় থাকা লোকদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করবে৷ যার ফলে যেখানে ন্যায্যতা এবং সহানুভূতির জন্য ব্রিটেনের বৈশ্বিক খ্যাতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাজ্যে বেড়েছে অভিবাসী আগমন, যদিও পিছিয়ে ইইউ থেকে
প্রতি বছর হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আশায় উত্তর ফ্রান্স উপকূলে ভিড় করে। তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায়, তারা সেখানে যেতে চান। ফলে ফ্রান্সে আশ্রয় আবেদন করে ফরাসি সরকারের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন না তারা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফরাসি উপকূলে সীমান্ত নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই ডিঙ্গি এবং অন্যান্য ছোট নৌকায় যাত্রা করার চেষ্টা করে থাকেন।
২০২২ সালে ৪৫ হাজারেরও বেশি লোক নৌকায় করে ব্রিটেনে এসেছিলেন৷ ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার এবং ২০২০ সালে ছিল ৮ হাজার ৬০০ জন।
এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগ (প্রায় ৯০ শতাংশ) ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন৷ কিন্তু দেশটিতে এক লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷ ফলে হাজারো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দীর্ঘদিন ধরে আশ্রয় প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র ও হোটেলে অবস্থান করতে হচ্ছে। মিলছে না বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি৷
ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টের মতে, হোম অফিসের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুমান করছে, ২০২৩ সালেও ছোট নৌকায় চ্যানেল পারাপার আরও বেড়েছে৷ ইতিমধ্যেই জানুয়ারির শুরু থেকে চ্যানেল জুড়ে প্রায় তিন হাজার লোক এসেছেন৷ যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা ২০২২ সালে প্রায় ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে। যা বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এই সংখ্যা ফ্রান্স বা জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই দুটি দেশ গত বছর দুই লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি আশ্রয় আবেদন নথিভুক্ত করেছে।
সরকারের ‘যুক্তি’
চ্যানেল অতিক্রমকারীদের ঠেকাতে সরকারের একটি জনপ্রিয় যুক্তি হচ্ছে, অভিবাসীদের অনেকেই ‘প্রকৃত উদ্বাস্তু’ নয় বরং তারা ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’।
উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ সরকার গত বছর আলবেনিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের দিকে ইঙ্গিত করেছে৷ কারণ আলবেনিয়াকে যুক্তরাজ্য সরকার নিরাপদ দেশ মনে করে।
মঙ্গলবার দ্য সান পত্রিকায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, “যারা ছোট নৌকায় করে আসছেন তারা সরাসরি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে পালিয়ে আসছেন না অথবা জীবনে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন না। তার পরিবর্তে তারা চ্যানেল অতিক্রম করার আগে নিরাপদ ইইউ দেশগুলোর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছেন।”
নিরাপদ রুটের আবেদন
মানবাধিকার এবং শরণার্থী গোষ্ঠীগুলোর মতে, অভিবাসীরা চ্যানেল যাত্রার ঝুঁকি নিয়ে থাকে কারণ যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর নিরাপদ এবং আইনি উপায় খুব কমই আছে।
শরণার্থী সহায়তা গোষ্ঠী কেয়ার ফর কালের সদস্য ক্লেয়ার মোসেলি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “মানবপাচারকারীদের থামিয়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জনে নিরাপদ রুট তৈরি করা আরও কার্যকর উপায় হবে।”
তিনি আরও বলেন, “অভিবাসনপ্রত্যাশীেদর নিরাপদ রুটে যুক্তরাজ্যে আসার প্রস্তাব দিতে হবে, যাতে তারা যুক্তরাজ্যে তাদের আশ্রয় আবেদন করতে পারে৷ তাহলে ৯০ শতাংশ লোক পাচারকারীদের কাছ থেকে দূরে থাকবে৷ আমাদের কাছে এর নজির রয়েছে কারণ আমরা ইউক্রেনীয়দের নিরাপদ রুট দিয়েছি।”
নতুন বিল কি কার্যকর হবে?
সরকার বলছে নতুন আইন চালু হলে, এটি আফগানিস্তান, হংকং এবং ইউক্রেন থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আশ্রয়ের আরও আইনি পথ তৈরি করবে। তবে কতজন আশ্রয়প্রার্থীকে নেওয়া হবে বা কখন এই প্রোগ্রাম শুরু হবে তা বলা হয়নি।
মোসেলিসহ অ্যাক্টিভিস্টরা সতর্ক করেছেন যে আইনটি আরও দীর্ঘ বিলম্ব এবং আশ্রয় আবেদনের দীর্ঘ জটিলতার দিকে পরিচালিত করবে। অনেক আশ্রয়প্রার্থী ইতিমধ্যেই তাদের আবেদনগুলো প্রক্রিয়া করার আগে ১৮ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চ্যানেল পারাপার নিয়ে গবেষণা করছে একটি গবেষক দল৷ সেই দলের সদস্য শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী লুসি মেব্লিন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আগের পরিকল্পনায় নৌকাগুলো বন্ধ করার সম্ভাবনা কম ছিল। কারণ সারা বিশ্ব থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আশ্রয়ের আবেদনের সংখ্যাকে প্রভাবিত করে না।”
তিনি আরো বলেন, “লোকেরা কেন ফরাসি উপকূল ত্যাগ করে সে সম্পর্কে আমরা জানি। গত ৩০ বছরে ফ্রান্সের ব্রিটিশ সীমান্তে বিনিয়োগে এবং গত বছরে পাস হওয়া জাতীয়তা ও সীমান্ত আইনের তেমন কোন প্রভাব কাজ করেনি। তা থেকে বোঝা যায় যে প্রতিবন্ধকতার প্রভাব আসলে এখানে কাজ করবে না।”
সমালোচকরা আরও উল্লেখ করেছেন, এই বিলটি অবৈধভাবে আগতদের ফেরত পাঠাতে ব্রিটিশ হোম অফিসের ওপর একটি আইনি দায়িত্ব আরোপ করবে। তবে তৃতীয় কোন নিরাপদ দেশ তাদের নিতে ইচ্ছুক হবে কী না সেটিও স্পষ্ট নয়।
ব্রেক্সিটের আগে, যুক্তরাজ্য ডাবলিন বিধিমালার অংশ ছিল। এটি একটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিত্তিক ব্যবস্থা, যার মধ্য দিয়ে আশ্রয়প্রার্থীরা ইউরোপে আসার পর প্রথম দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম করত।
কিন্তু যুক্তরাজ্যের পক্ষে ডাবলিন বিধিমালায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ ফলে, যুক্তরাজ্য গত বছর রুয়ান্ডার সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে, যাতে ব্রিটেনে আগত অভিবাসীদের কিগালিতে স্থানান্তর করা হবে৷ এই পরিকল্পনাটি এখনও আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং এখনও পর্যন্ত পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে কাউকে পাঠানো হয়নি। যদিও ব্রিটেন ইতিমধ্যে চুক্তির অধীনে রুয়ান্ডাকে ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়েছে৷
‘ব্যয়বহুল এবং মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন’
এই আইনের সমালোচকদের মতে, চ্যানেলে আসা ব্যক্তিদের আটকে রাখার জন্য পর্যাপ্ত স্থান খুঁজে পাওয়াও একটি বড় বাধা হবে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাইগ্রেশন অবজারভেটরি বলছে, যুক্তরাজ্যে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৫১৩ জনকে আটক রাখার সক্ষমতা রয়েছে।
মেবলিন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন,
একজন ব্যক্তিকে আটকে রাখার জন্য প্রতিদিন জনপ্রতি ১০৭ পাউন্ড খরচ হয়। গত বছর যারা চ্যানেল জুড়ে এসেছিল তাদের আটক রাখতে ১৭৫ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি খরচ হয়েছে। আটক রাখার পরিকল্পনাগুলো দুর্বল অভিবাসীদের জন্য আরও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, “মূলত পরিকল্পনা হল একজন ব্যক্তিকে ২৮ দিনের জন্য আটকে রাখা এবং পরবর্তীতে তাদেরকে সরকারি আশ্রয় সুবিধা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া। এর অর্থ হল একটি বড় এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে ন্যূনতম অধিকারের বাইরে রাখা। মনে হচ্ছে, এই মানুষগুলো শোষণের ঝুঁকিতে থাকবে।”
অভিবাসন এবং শরণার্থী আইন বিশেষজ্ঞ কলিন ইয়ো টুইটারে বলেন,
অভিবাসীদের আটকে রাখার বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হবে। কারণ সত্যিই যদি সবাইকে ২৮ দিন আটকে রেখে পরে কোনো ব্যবস্থা ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে এটি অদ্ভুত হবে। এটি সত্যিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল, অর্থহীন এবং সম্ভবত ইসিএইচআর [ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস] এর লংঘন হবে।
এই আইনটি ‘ব্যয় বাড়াবে ও বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী এনভার সলোমন৷ তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে বিপুল খরচে হাজার হাজার লোককে স্থায়ীভাবে অচলাবস্থায় আটকে রাখা হবে। শুধুমাত্র আশ্রয় চাওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে অপরাধী হিসাবে আচরণ করা হবে।”