শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন

মেক্সিকো একটি বৈচিত্র্যময় এবং ঐতিহাসিক দেশ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Hispanic young couple holding a coconut and having fun on caribbean beach in holidays or vacations in Mexico Latin America

মেক্সিকো একটি বৈচিত্র্যময় এবং ঐতিহাসিক দেশ, যা উত্তর আমেরিকার দক্ষিণে অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন, যেখানে অসংখ্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অজেক্টেক, মায়া, ওলমেক, তলটেক, এবং অন্যান্য বহু সভ্যতা অন্তর্ভুক্ত। মেক্সিকোর ইতিহাস একদিকে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি অন্যদিকে এক ধরনের সংঘর্ষের ইতিহাসও। এই গল্পের মাধ্যমে মেক্সিকোর ঐতিহাসিক ঘটনা, সংস্কৃতি, এবং সমাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে।

প্রাচীন সভ্যতা এবং মায়া অজেক্টেক

মেক্সিকোর ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় শুরু হয় প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকে। মেক্সিকো ছিল মায়া এবং অজেক্টেক সভ্যতার জন্মস্থান। মায়া সভ্যতা দক্ষিণ মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এবং বেলিজে বিস্তৃত ছিল। তারা অত্যন্ত উন্নত গণনা পদ্ধতি, জ্যোতির্বিদ্যা, এবং স্থাপত্যে দক্ষ ছিল। মায়ারা পিরামিড, মন্দির, এবং অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নির্মাণ করেছিল। মায়া সভ্যতা প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বে শুরু হয় এবং ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পতিত হয়।

অজেক্টেকরা ছিলেন মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের একটি শক্তিশালী জনগণ। তাদের রাজধানী টেনোচটিটল ছিল, যা আজকের মেক্সিকো সিটির পূর্বসূরি। তারা পিরামিড, মন্দির এবং সড়ক নির্মাণে বিশেষভাবে দক্ষ ছিল। অজেক্টেকরা কৃষি, বাণিজ্য এবং যুদ্ধবিদ্যায় অত্যন্ত পটু ছিল। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল যে তাদের দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে sacrifices বা প্রাণদান করতে হবে।

স্প্যানিশ উপনিবেশ

১৫১৯ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী এর্নান কোর্টেস মেক্সিকোতে পৌঁছান। স্প্যানিশদের আগমনে মেক্সিকোর স্থানীয় সভ্যতাগুলোর পতন ঘটে। কোর্টেস এবং তার বাহিনী, যাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু জাতি যোগ দেয়, অজেক্টেকদের রাজ্য টেনোচটিটল দখল করে এবং মেক্সিকোকে স্প্যানিশ উপনিবেশে পরিণত করে। ১৫২১ সালে মেক্সিকো পুরোপুরি স্প্যানিশ শাসনের অধীনে চলে আসে।

স্প্যানিশ শাসনকালে মেক্সিকোতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারিত হয় এবং স্থানীয় জনগণকে অত্যন্ত শোষণ করা হয়। স্প্যানিশরা মেক্সিকোর সমৃদ্ধ সোনা, রূপা, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করেছিল। এই শোষণের ফলে মেক্সিকোর স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

১৮১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, মেক্সিকোর জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। মিগুয়েল হিদালগো নামক একজন ক্যাথলিক পাদ্রি “গ্রিতো দে দেলোর” নামক বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়ে মেক্সিকোর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন। হিদালগোর নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ স্প্যানিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সংগ্রামটি দীর্ঘ ১১ বছর স্থায়ী হয় এবং ১৮২১ সালে মেক্সিকো স্প্যানিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

মেক্সিকোর রাজনৈতিক ইতিহাস

স্বাধীনতার পর মেক্সিকো একটি দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। ১৮৪৬-১৮৪৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর মধ্যে এক যুদ্ধ শুরু হয়, যা “মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধ” নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ, মেক্সিকো তার বিশাল ভূখণ্ডের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রকে হারায়, যার মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ মেক্সিকো, এবং টেক্সাস অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯১০ সালে মেক্সিকোতে একটি বিপ্লব ঘটে, যা মেক্সিকোর সমাজ ও রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। এই বিপ্লবের ফলে মেক্সিকোতে ভূমির সংস্কার, শ্রমিকদের অধিকার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়।

মেক্সিকোর আধুনিক যুগ

আজকের মেক্সিকো একটি বহুজাতিক এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে পূর্ণ দেশ। এটি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র। মেক্সিকোতে নানা ধরনের শিল্প, কৃষি, এবং সেবা ক্ষেত্র রয়েছে। দেশটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ, যেখানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল হিসেবে স্বীকৃত বেশ কিছু স্থান রয়েছে, যেমন চিচেন ইতজা, টিওতিহুয়াকান, এবং উক্সমাল।

মেক্সিকোর সংস্কৃতিতে মিউজিক, নৃত্য, এবং খাবারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। মারিয়াচি মিউজিক, ফ্লামেঙ্কো, এবং ল্যাটিন রিদমের জগতেও মেক্সিকোর বিশাল অবদান রয়েছে। তাছাড়া, মেক্সিকোর রন্ধনশিল্পও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, যার মধ্যে টাকোস, এনচিলাদাস, গুয়াকামোল, এবং টেম্পুরা অন্যতম।

মেক্সিকো একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এর প্রাচীন সভ্যতাগুলির ইতিহাস থেকে শুরু করে, স্প্যানিশ উপনিবেশ এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম, মেক্সিকো বিভিন্ন সময়ে অনেক কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করেছে। তবে আজকের মেক্সিকো তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার গর্ব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

মেক্সিকো একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দেশ, যেখানে দর্শনীয় স্থানগুলোর সংখ্যা অসংখ্য। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, মন্দির, মিউজিয়াম, সৈকত এবং আরও অনেক কিছু। চলুন, মেক্সিকোর কিছু আকর্ষণীয় জায়গা সম্পর্কে জানি।

১. চিচেন ইতজা (Chichen Itza)

চিচেন ইতজা একটি প্রাচীন মায়ান শহর এবং মেক্সিকোর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। এখানে অবস্থিত “এল কাস্তিলো” পিরামিডটি বিশেষভাবে বিখ্যাত, যা মায়ান সভ্যতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তাদের জ্যোতির্বিদ্যা জ্ঞানের প্রমাণ। এটি একটি অবিস্মরণীয় স্থান, যেখানে প্রাচীন মায়ান সভ্যতার সংস্কৃতি অনুভব করা যায়।

২. টিওতিহুয়াকান (Teotihuacan)

টিওতিহুয়াকান শহরটি মেক্সিকোর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। এটি মেক্সিকো সিটির উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এবং এখানকার “সানড লুন” (পিরামিড অফ দ্য সান) এবং “লা পিরামিড অফ দ্য মুন” অত্যন্ত বিখ্যাত। এই পিরামিডগুলো দর্শনার্থীদের মেক্সিকোর প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত করতে সাহায্য করে।

৩. ক্যানকুন (Cancun)

ক্যানকুন মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান উপকূলে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটি তার সুন্দর সাদা বালুকাময় সৈকত, সবুজ জল এবং অত্যাধুনিক রিসোর্টের জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। ক্যানকুনে ভ্রমণ করলে আপনি স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, এবং অন্যান্য জলক্রীড়া উপভোগ করতে পারবেন।

৪. পুয়ের্তো ভায়ার্তা (Puerto Vallarta)

পুয়ের্তো ভায়ার্তা মেক্সিকোর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সৈকত শহর। এটি তার শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ এবং আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এখানকার সুন্দর সৈকত, টেকিলা সংস্কৃতি, এবং জঙ্গল রিসোর্ট পর্যটকদের জন্য একটি আদর্শ স্থান।

৫. মেক্সিকো সিটি (Mexico City)

মেক্সিকো সিটি দেশের রাজধানী এবং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং আধুনিকতার মিশ্রণ। এখানে মিউজিয়াম, প্রাচীন স্থাপত্য, এবং একটি প্রাণবন্ত শহুরে জীবন রয়েছে। সিটি সেন্টারে অবস্থিত “জোকালো” (Zócalo) বা প্লাজা ডি লা কাস্টিল্লান, যা বিশ্বের একেবারে বড় স্কোয়ার, তার ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য উল্লেখযোগ্য।

৬. কোবা (Coba)

কোবা মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন মায়ান শহর। এখানে বিশাল পিরামিড রয়েছে যা আপনার চমৎকার অনুভূতি তৈরি করবে। কোবার পিরামিডটি সবচেয়ে উঁচু মায়ান পিরামিডগুলোর মধ্যে একটি, যা প্রায় ৪২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় চ্যালেঞ্জ।

৭. অক্সাকা (Oaxaca)

অক্সাকা একটি ঐতিহাসিক শহর, যা মেক্সিকোর দক্ষিণে অবস্থিত। এটি তার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা, নৃত্য, এবং খাবারের জন্য বিখ্যাত। এখানে গেলে আপনি মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেমন টাকো, মল, এবং মেজ কালাম্বো উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়া অক্সাকাতে রয়েছে প্রাচীন মেক্সিকান স্থাপত্য এবং শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন।

৮. লস কাবোস (Los Cabos)

লস কাবোস মেক্সিকোর একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, যা বাইত ভ্রমণকারীদের জন্য আদর্শ। এটি মূলত দুটি শহর, কাবো সান লুকাস এবং সান জোসে ডেল কাবো দ্বারা গঠিত। এখানে আপনি মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের সবচেয়ে সুন্দর সৈকত এবং বিলাসবহুল রিসোর্ট উপভোগ করতে পারবেন।

৯. কোকো (Coco)

কোকো মেক্সিকোর একটি প্রাচীন শহর যা পাহাড়ে অবস্থিত। এটি একটি আকর্ষণীয় শহর এবং এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। আপনি এখানকার পাহাড়ি পথ দিয়ে হাইকিং করতে পারেন, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ইতিহাসের মিশ্রণ দেখা যায়।

১০. হুয়াটুলকো (Huatulco)

হুয়াটুলকো হল মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি সমুদ্র সৈকত শহর। এখানে প্রচুর নির্জন সৈকত এবং সুস্পষ্ট পানি রয়েছে, যা একটি স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করে। আপনি এখানকার জঙ্গল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি বিশ্রাম নিতে পারেন।

উপসংহার

মেক্সিকো বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ এবং এখানে রয়েছে দর্শনীয় অনেক স্থান। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, সৈকত, পাহাড়, এবং শহরের সৌন্দর্য মেক্সিকোকে একটি আদর্শ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। আপনি যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, এবং আধুনিক জীবনযাত্রা উপভোগ করতে চান, তাহলে মেক্সিকো আপনার জন্য একটি আদর্শ জায়গা হতে পারে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com