বিদেশে কর্মী প্রেরণে যেসব দেশ থেকে বেশি চাহিদা আসছে তার মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এ নিয়ে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশে থাকা জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৌদিসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাতে আগ্রহী শ্রমিকদের বেশির ভাগই এখন মালয়েশিয়া যেতে চাচ্ছে। যার কারণে খুব অল্প সময়ে এই শ্রমবাজারটি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
এদিকে মালয়েশিয়া সরকারের পছন্দের ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে চালু হওয়া নতুন এই শ্রমবাজারে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত দুই লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য পাড়ি জমানো শ্রমিকদের মধ্যে থেকে এখন পর্যন্ত ৪-৫ হাজার শ্রমিকের সমস্যা দেখা দিয়েছে। যাদের বেশির ভাগ যাওয়ার পর কাজ পায়নি। আবার কাজ থাকলেও বেতন নাই। পরবর্তীতে এসব শ্রমিক তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
অপর দিকে ঢাকার গুলশানের গ্রিনল্যান্ড ওভারসিস থেকে পাঠানো শ্রমিকদের মধ্যে থেকে ১৯ জন কর্মী সার্ভার জটিলতার কারণে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে পৌঁছার পরও প্রবেশ করতে পারেনি। অবশ্য একদিন পর ফিরতি ফ্লাইটে তাদেরকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ফেরত পাঠানোর ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যদিও পরবর্তীতে রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিস কর্তৃপক্ষ ফেরত আসা ১৯ শ্রমিকের বিমান টিকিটসহ অন্যান্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েই আবার নিয়োগকারী কোম্পানিতে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিসের পরিচালক মফিজুর রহমান নয়া দিগন্ত প্রতিবেদকের কাছে আগেই নিশ্চিত করেছিলেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার আগে বহির্গমন ছাড়পত্র ও অন্যান্য যাবতীয় কাজের দায়িত্ব পালন করছেন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বহির্গমন) উপপরিচালক মো: সাজ্জাদ হোসেন। গত সপ্তাহে তিনি তার দফতরে এ প্রতিবেদককে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বশেষ হালচাল ও বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার তথ্য জানিয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৬ হাজার কর্মীর নামে আমাদের এখান থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমার দেখা মতে মালয়েশিয়াতে প্রতিদিন ভালোই কর্মী যাচ্ছে। একইভাবে ঢাকার পার্টে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা নিয়ে কেউ আসেননি। মালয়েশিয়ায় কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে সেটি আমার অবশ্য দেখার বিষয় না।
এরপরও মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের মধ্যে কারো যদি কোনো সমস্যা হয়েই থাকে তাহলে সেটিও আমি আমার টিমের অপর সহকর্মীদের নিয়ে দ্রুত সমাধান করে ফেলছি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো একটি খবর হচ্ছে, কযেক দিন আগে বিনা খরচে ২০ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সার্বিক তত্ত্ব¡াবধানে জে জি আল ফালাহ ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনায় তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় একটি চমক মনে হচ্ছে আমার কাছে। তিনি বলেন, বিনা খরচে আরো বেশি বেশি কর্মী কিভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠানো যায় সে ব্যাপারে আমাদের সম্মিলিতভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রতি মাসে কী পরিমাণ শ্রমিক যাচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, চলতি জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজারের মতো শ্রমিক চলে গিয়েছে। এর আগের ৫ মাসে আরো ১ লাখ ৩৬ হাজার শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছে। সব মিলিয়ে দুই লাখ ৫-৬ হাজার শ্রমিক যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি আমরা। তার মতে, নতুন শ্রমবাজার হিসাবে এই মুহূর্তে অন্যান্য দেশের চেয়ে মালয়েশিয়াতে শ্রমিক বেশি যাচ্ছে। বলতে গেলে চাঙ্গা।
গতকাল রাতে মালয়েশিয়া থেকে একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, এ মুহূর্তে নতুন অ্যাপ্রুভাল কবে নাগাদ মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন থেকে বের হবে তা নিয়ে সবাই অপেক্ষায় আছে। অবশ্য এর আগে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ৪ লাখ অ্যাপ্রুভালের কোটা দিয়েছে। যার মধ্যে দুই লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়াতে চলেও এসেছে। এর মধ্যে ৩-৪ হাজার শ্রমিকের কাজ না পাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছে। ওই শ্রমিকরা তাদের নিয়োগকারী এবং রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে বলে শুনেছি। তবে এর মধ্যে কতজন শ্রমিকের সমস্যা হাইকমিশন করতে পেরেছে তা অবশ্য হাইকমিশন থেকে অথবা শ্রমিক প্রেরণের সাথে সম্পৃক্ত জনশক্তি ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করতে বলতে পারেননি।
মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগ শাখার এক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ভালোই চাঙ্গা হয়েছিল। তবে কয়েক দিন ধরে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন তিনি। কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি অ্যাপ্রুভাল একাধিক লোকের হাতে ঘোরাঘুরি করছে। তিনি এজেন্সি মালিকদের এসব অ্যাপ্রুভাল কেনার আগে যাচাই বাছাই করে তার পর আর্থিক লেনদেন করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট। এই টিকিট সিন্ডিকেটের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে অনেকেই কম টাকায় মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ইচ্ছা করলেও তা পারছেন না বলে তিনি মনে করছেন।
এ দিকে দুই দেশের শ্রমবাজার বিশ্লেষকরা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলছেন, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় এফডব্লিওসিএমএস পদ্ধতিতে কর্মী প্রেরণ করায় প্রতি কর্মীর বিপরীতে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় বাড়ছে। এখন এটি আরো কমিয়ে কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে এক হয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও তারা মনে করছেন। তাহলে মালয়েশিয়ায় চলতি বছর আরো দুই লাখেরও বেশি কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়া হাইকমিশন ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের কারণে প্রত্যেক কর্মীর ‘সত্যায়ন’ করানো নিয়ে মালয়েশিয়ান ৭০-১০০ রিংগিট হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মালয়েশিয়া প্রতিনিধি জানান, কয়েক দিন ধরে মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমের আলোচনার একটি বড় অংশ ছিল কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি ঘটনা। যেখানে একজন চীনা পর্যটকের সঙ্গে দেশটির ইমিগ্রেশনের এক ঘটনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন দেশটির একজন মন্ত্রী। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনা আর সমালোচনায় যখন সরব দেশটির সংবাদপত্রগুলো এমন সময় গতকাল হঠাৎই কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ঝটিকা পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। এ সময় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখেন তিনি। এ ছাড়াও বিমানবন্দরে উপস্থিত স্থানীয় এবং বিদেশী যাত্রীদের সাথেও কথা বলেন তিনি।
এর মধ্যে সেখানে সদ্য অবতরণকৃত কলিং ভিসার বাংলাদেশী কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। দেশটির গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ভিডিওর সূত্রে দেখা গেছে এ সময় নতুন যাওয়া বাংলাদেশী কর্মীদের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুশলাদিও জানতে চান আনোয়ার ইব্রাহিম। এ ছাড়াও এসব বাংলাদেশী কর্মীদের কাগজপত্রও তিনি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখেন।
বাংলাদেশী কর্মীরাও মালয়েশিয়ায় প্রবেশকালেই এমন অনাকাক্সিক্ষত আর চমৎকার অভ্যর্থনায় কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে আরো দেখা যায় বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সঙ্গেও আলাপ করেন তিনি।