আমি উদ্ভট চিন্তা করার একজন পারদর্শি মানুষ। পথ চলতে চলতে মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবি নজরূল যদি এই পথ দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যেতেন তাহলে উনারা কি কবিতা বা গান লিখতেন? ‘একি অপরুপ রুপে মা তোমার হেরিনো পল্লী জননী’ নাকি অন্য রকম কিছু? যেতেযেতে দেখতে পাচ্ছি একরের পর একর চাষের জমি। পাশে র্ফাম হাউজ । আর বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বাড়ী। মনে মনে ভাবী কারা থাকে এই সব বাড়ীতে? এমন নিস্তব্ধ এলাকায় থাকতে ওদের ভয় করে না? যেতে যেতে আবার কখনো দেখলাম বড় রাস্তা থেকে মেঠো পথ ভেতরের দিকে চলে গেছে। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায়রে।’
বৃষ্টির পালা শেষ হয়ে গেছে। আকাশ হেসে উঠেছে উজ্জল রোদে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো একরাশ হলুদ আভা। বিপুল পরিমার জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয় সর্ষে ক্ষেত। যাকিনা আমাকে নিয়ে যায় আমার শৈশবের কোন এক সময়ে। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। রাস্তার দুপাশে কাশফুল ফুটার অপেক্ষায় বাতাসে দোল খাচ্ছে।
গাড়ী চলেছে ওয়াটন উইলী নামের ছোট শহরটির উপর দিয়ে। এই শহরটি থেকে অন্টারীওর একবছরের আবহাওয়ার পূর্বাভাশ জানানো হয়। ব্যাপারটি বৈজ্ঞানিক নয় একধরনের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এই পুর্বাভাস দেয়া হয়। এখানে ওয়াটন উইলী নামে একাধীক মানুষ আছে। যারা বছরের কোন এক সময় একটি গুহায় ঢুকে ছায়া দেখে পুরো বছরের আবহাওয়া বার্তা জানায়। এই বছর কতটা শীত পরবে ,কতটা তুষারপাত হবে। উষ্ণ আবহাওয়া মানুষ কতটুকু উপভোগ করবে ইত্যাদি। কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করে কেউ করে না। অবশ্য কখনো কখনো ঝড়ে বক মরার মতো তাদেও ভবিষ্যত বানী ঠিকও হয়ে যায়।
পরদিন আমরা রওয়ানা হলাম ফ্লাওয়ার পট আয়লেন্ডের উদ্দেশ্যে। আবারো আমরা আঠারো জন। গ্লাসবটম নৌকাতে বসে আছি আমরা । নৌকার গতি দেখে মনে হচ্ছে এখনি আমরা উল্টে পরবো। শান্ত লেক হিরন অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড বাতাস বইছে। দুরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাল তোলা নৌকো দুলে দুলে যাচ্ছে । লেকের পানির কি রং? নীল নাকি সবুজ ? বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যেতে যেতে জন মানব হীন ছোট ছোট দ্বীপ চোখে পরছিল। সেগুলো শুধুই পাথর আর পাথুরে গাছ দিয়ে গড়ে উঠেছে । তীরে দেখা যাচ্ছিল ছোট ছোট পাথরের নুড়ী। যাদেখে আমার মনে পরে গেল ছোট বেলার পাথর কুড়ানোর স্মৃতি।
সারাদিন ফুলদানি দ্বীপে ঘুরলাম। হাজার হাজার বছর ধরে পাথর ক্ষয় হতে হতে সেগুলো একেকটা ফুলদানির আকার ধারন করেছে। সেগুলোতে বেড়ে উঠেছে নানা রকমের পাথুরে ফুল । সে জন্যই হয়তো এই দ্বীপটির নাম ফ্লাওয়ার পট । পরদিন দেখতে গেলাম সেখানকার ন্যাশাণাল পার্ক। সেখানে যে বাস করে কত রকমের পাখি কত রকমের গাছ তা জানতে পারলাম। প্রতিবারের মত এবারও মহা আনন্দে চার পাঁচদিন কটেজ ট্রিপে ঘুরে এলাম। সারাদিন নানা জায়গায় ঘুরাঘুরি, বিকেলে বার-বা-কিউ, রাতে বন ফায়ার জালিয়ে আড্ডা গান চললো। ফিরে আসার দিন সবার মন খারাপ। আবারো সে একঘেয়েমি জীবন । তারপরও ঘরে ফেরার একটা আনন্দ মনের মাঝে রিন রিন করে বেজে উঠলো।
লেকের ধার দিয়ে ফেরার পথে আমি মাথা ঘুড়িয়ে তাকালাম। মনে মনে যেন সে মেয়েটিকে আবারো খুজলাম। আজও মেয়েটির কথা মনে হলে আপন মনেই বলি, ‘এই মেয়ে তুমি ভালো আছোতো ? তুমি কি এখনো খেলে যাচ্ছ তোমার পানিতে ডুবে থাকা আর তীরে উঠে আসার খেলা’?
কটেজের ঘুরা ঘুরি শেষ করে সবার কাছ থেকে সবাই বিদায় নিয়ে পরবর্তী ট্রিপের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে যার যার গন্তব্যে রওয়ানা হলাম। শুরু হোল আমার নিয়মিত জীবন। সেটাও মন্দ কিছু না। নানাভাবে আনন্দে , ক্লান্তিতে, ব্যস্ততায় রাতের পর সকাল আর সকালের পর রাত এসে যায় ।
আমরা বর্তমানে ফুলে ফলে ভরা যে বাড়ীটিতে আছি সেখানেও দেখতে দেখতে আট বছর কেটে গেলো । আমাদের যাযাবর মন কেমন যেনো অস্থির হয়ে উঠলো । মাঝে মাঝে বিকেলে আমরা দুজন মিলে আশপাশটাতে ড্রাইভিং করে আসি । আমাদের থেকে কিছূটা দুরেই একটা খুব নিরিবিলি শহর । চারপাশে প্রচুর খালি জায়গা । ভূট্টা ক্ষেত , অ্যাপেল বাগান , চেরি বাগান , কেণোলাড় ক্ষেতে শর্ষে ফুলের মতো ফুল ফূটে হলুদ হয়ে আছে। অনেক আগে এখানে এসে বাড়ী করেছিলো তারাই এখানকার আদি বাসিন্দা । আমাদের খুব পছন্দের এই শহরটা । পুরো শহরটা জুড়ে একটা শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। এই শহরটা বড় এবং আধুনিক করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে । বহু বিল্ডার এসে গেলো মিলটন শহরে নানা রকমের প্রজেক্ট নিয়ে ।এই শহরের প্রতি আমাদের একটা অজানা ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল । বেশ কিছু বিল্ডার অফিস খুলে গেলো এখানে বাড়ি বানানোর ব্যবসায় । আমরা একদিন ধম করেই এক বিল্ডারের অফিসে ঢুকে গেলাম। অফিস থেকে আমাদের একটা এপয়েনমেন্ট দিয়ে দিলো বিস্তারিত আলাপ আলোচলার জন্য, সাথে কিছু ফলায়ের দিয়ে দিলো দেখার জন্য ওরা কোথায় কোথায় তাদের প্রজেক্ট , কোথায় কোথায় ওরা বাড়ি বানাবার কাজ করছে।
যাই হোক আমরা বাড়ীতে ফিরে কাজকর্ম শেষ করে কাগজ পত্র খুলে বসলাম । আমরা নিজেরা কথা বলে ঠিক করে নিলাম যদি আমাদের পছন্দ মতো পাই তাহলে কতো হাজার স্কয়ার ফিট বাড়ি এবং কোন ডিজাইনের বাড়ি নিবো । সময় অনুযায়ী আমরা ওদের অফিসে গেলাম। সব কিছু নিয়ে কথা বার্তা হলো । তারপর ওরা আমাদের নিয়ে বের হলো তাদের তৈরি করা মডেল হাউস দেখাতে। কেমন বাড়ি আমাদের আমাদের পছন্দ। আমরা বেশ অনেকগুলো বাড়ি দেখে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটা বাড়ীর মডেল পছন্দ করলাম। মিনিমাম কিছু টাকা জমা দিয়ে বুকিং দিয়ে আসলাম। ওরা দেখালো কোথায় আমাদের বাড়িটা উঠবে ।
এখানে খালি মাঠ দেখলাম। কি জানি কবে এখানে বাড়ি উঠবে ? বিল্ডারদের সাথে আরো কয়েবার মিটিং হোলো । তাদের কথা অনুযায়ী বাড়ি পেতে একবছর লাগবে। এতে আমাদের কোনই সমস্যা নেই। বাড়ীর কাজ শুরু হবার পরে বহুবার আমাদের ওদের বিভিন্ন বিভাগে যেতে হোলো । আমাদের বাড়ীর সবকিছুর ফিটিং , ফ্লোরের রঙ, বাথরুমের ডিজাইন , রান্নাঘরের ডিজাইন মোট কথা বাড়ীর প্রত্যেকটা জিনিসই আমাদের নিজেদের পছন্দের মতো দিলাম। এতে করে আমাদের বাড়ীর দাম অনেকটা বেড়ে গেছিলো । এক বছরের অপেক্ষা । আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে যেতাম বাড়ীর কাজ।