বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ অপরাহ্ন

মরুর বুকে যেন প্রকৃতির সাজ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩

লিসবন থেকে বাড়ি ফেরার পথে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের বিস্ময়কর নগরী দুবাইয়ে ঘোরার ইচ্ছে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের বাংলাদেশি বৈধ অভিবাসীদের জন্য এমিরেটস এয়ারলাইন্স ব্যবহারে দুবাইয়ের ভ্রমণ ভিসা পাওয়া যায় খুবই সহজে। কনফার্ম টিকিট দিয়ে ভিসা আবেদন করলে ৩-৪ দিনের মধ্যে ১ মাসের ই-ভিসা দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত।

লিসবন থেকে দীর্ঘ প্রায় আট ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষে স্থানীয় সময় ৮টা ১৫ মিনিটে দুবাই বিমানবন্দরে অবতরণ করি। যদিও রাতের বিমানযাত্রা ছিল কিন্তু তেমন একটা ক্লান্তি আসেনি দেহে। এমিরেটস এয়ারলাইন্সে এই রুটের যাত্রী বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান ফলে ইকোনমিক ক্লাসের যাত্রী সেবার মান ছিল অত্যন্ত ভালো। রাতের খাবার, সকালের নাস্তাসহ কিছুক্ষণ পরপর চা কফি বা ড্রিংকস অফার করছে রমণীরা!

Dubai1

প্রথম দিনে বেশকিছু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে, বুর্জ আল খলিফা টাওয়ার (বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন), দুবাই মল, বুর্জ আল আরব (বিশ্বের একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল) পাম জুমেইরা, দুবাই মিরাকল গার্ডেন ছিল অন্যতম। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দালান দেখার জন্য চলে এলাম বুর্জ আল খলিফা টাওয়ারের প্রান্তে। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে কোনো ধরনের অভিবাদনমূলক শব্দ ব্যবহার করেনি! তাই শুরুতে মনটা খারাপ ছিল।

এশিয়া এবং ইউরোপের বেশকিছু দেশে পর্যটক ভিসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে এবং সকল দেশে ইমিগ্রেশনে অন্তত হাসিমুখে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও দুবাই ইমিগ্রেশনে কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়া ইমিগ্রেশন শেষ করেছে কিন্তু অফিসারের মুখ থেকে কোনো একটি কথা বের হলো না। একজন পর্যটক হিসেবে শুভ সকাল বা স্বাগতম শব্দটা অন্তত আশা করতে পারি।

Dubai1

মনে একটু ব্যথা নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম। আগে থেকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ভাই এবং বন্ধুরা। দুবাই শহরের প্রাকৃতিক ফুলে সজ্জিত প্রশস্ত রাস্তা এবং সুউচ্চ দালানের সারি নিমিষেই যে কারো মন কেড়ে নেবে। গাড়ির মধ্যে থেকে চারপাশের পরিবেশ দেখে কিছুটা মনে প্রশান্তি ফিরে এলো।

সকালের নাস্তা করতে পাকিস্তানি একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম। নান রুটি আর পায়া ওর্ডার করলাম। এক একটি নান আমাদের লিসবন বা ঢাকার চারটির সমান হবে। আমরা ২-৩ জন মিলে একটি নান শেষ করেছিলাম। নাস্তা সেরে এবার গন্তব্য বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দালান বুর্জ আল খলিফা টাওয়ার। ছুটির দিন সকাল বেলা হওয়াতে তেমন একটা মানুষের সমাগম ছিল না। ভালই হলো মন খুলে ইচ্ছামতো কিছু ছবি নিতে পারলাম।

Dubai1

কৃত্রিম বিশাল লেক করা হয়েছে ভবনটির সম্মুখ অংশে এবং তার উপর বিশালাকৃতির জলের ফোয়ারা বসানো হয়েছে। দুঃখের বিষয় এটি শুধুমাত্র সন্ধ্যায় উন্মুক্ত করা হয়। সাথে থাকে মনোরম আলোকসজ্জা। বিস্ময় চোখে তাকিয়েছিলাম মানব তৈরি সর্বোচ্চ কাঠামোর দিকে। আমার মতো আরো বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। সাথেই ছিল দুবাই মল যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শপিং সেন্টার। সেখানে বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত করার পরে চলে গেলাম বুর্জ আল আরব দেখতে।

বিশ্বের একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল বুর্জ আল আরব। যদিও এটি একটি প্রতীকী উপাধি। আসলে দুনিয়াতে ৫ তারকার উপরে কোনো হোটেল নেই। বুজ আল আরব পাঁচ তারকার চাইতে বেশি কিছু। তাই সম্মানসূচক এটিকে সেভেন স্টার হোটেল বলে থাকে। দূর থেকে হোটেলটি দেখলে মনে হবে পাল তুলে কেউ সমুদ্র যাত্রায় বের হচ্ছে।

Dubai1

পাম জুমেইরা এবং দুবাই মিরাকল গার্ডেন যা সমুদ্র ও মরুভূমির বুকে সত্যি অসাধারণ সৃষ্টি। সাগরের বুকে সর্ববৃহৎ দ্বীপ যেখানে বিলাসবহুল ও দৃষ্টিনন্দন হাজার হাজার ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ এবং আবাসিক হোটেল করা হয়েছে। বসবাসের জন্য বিশ্বের ব্যয়বহুল জায়গা এটি যেখানে বিভিন্ন দেশের তারকা খ্যাতি বহুল ও ব্যবসায়ীদের বসবাস রয়েছে।

মিরাকল গার্ডেন যা মরুর বুকে সত্যি অসাধারণ সৃষ্টি। এখানে প্রবেশ করে কারও বোঝার উপায় নেই মরুভূমির কোন দেশে আছি নাকি চিরসবুজ কোনো উদ্যানে প্রবেশ করেছি। চারদিকে রং-বেরঙের বাহারি ফুলের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় রাশি রাশি ফুল গাছের মনোমুগ্ধকর সব আকৃতি দিয়ে সাজানো বাগান। আরব আমিরাতের বিভিন্ন ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাহারি সব প্রাকৃতিক চিত্র কর্মের মাধ্যমে।

দুবাই থেকে দ্বিতীয় দিন আবুধাবির পথে। উদ্দেশ্য বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও চমৎকার মসজিদ, শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ পরিদর্শন করা। সুবিশাল সৌন্দর্যমণ্ডিত মসজিদটি দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম ও নওমুসলিমদের বিপুল ভিড় লক্ষ্য করার মতো। আধুনিক যুগের চলমান একটি মসজিদ মানুষ টিকিট কেটে পরিদর্শন করছে ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে। আবার মুসল্লিরা নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে অনায়াসে যাতায়াত করছে।

Dubai1

আমরা মসজিদটি পরিদর্শন শেষে জামায়াতে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। আমি যেকোনো নতুন দেশে গেলেই অনন্ত দুই রাকাত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার এই অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টির শুকরিয়া প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সেজদা প্রদান আমার অন্যতম ভালোলাগার একটি কাজ।

শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ পরিদর্শন শেষে আবার দুবাই ফিরে আসি। বাংলাদেশি একটি রেস্টুরেন্টে ডাল, ভর্তা আর ইলিশ মাছ দিয়ে শতভাগ বাঙালি আনায় বিদেশে মধ্যাহ্নভোজ সম্পন্ন করি। সেখান থেকে শারজার উদ্দেশ্যে রওনা হই। শারজার বাংলাদেশি অধ্যুষিত জি এম জি এলাকা পরিদর্শন করি যা কিছুটা বাংলাদেশের মতো। এখানকার ভাঙা ছিঁড়া রাস্তাঘাট, ছোটছোট দোকান ঘর এবং অসংখ্য বাংলাদেশিদের আনাগোনায় দুবাইয়ের বুকে ‘একখণ্ড বাংলাদেশ’ পরিণত হয়েছে।

শারজায় আসার পরে কিছুটা উপলব্ধি হলো ইমিগ্রেশনে এমন আচরণ কেন করলো। এখানে হাজার হাজার বাংলাদেশিদের জীবন যাত্রার মান, কাজের ধরণ এবং তাদের স্বভাবসুলভ আচার-আচরণ আমাদের বিশেষ একটি পরিচয় তৈরি করেছে। যার ফলে আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হতে হয় এবং এয়ারপোর্টেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

Dubai1

যেকোনো ভ্রমণ আমাদের জীবনে ভালো মন্দ মিলিয়ে দারুন এক অভিজ্ঞতার সমষ্টি। ভ্রমণ আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণতা দান করে বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাই জীবনকে উপভোগ করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। আর যদি ভ্রমণের স্থানটি হয় আধুনিক ও দীর্ঘ ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্থান তাহলে আর কথায় নেই।

দুবাই হেরিটেজ ভিলেজে গিয়ে আরব আমিরাতের ৫-৬ দশক আগের জীবনযাপন আর বর্তমানের মধ্যে পার্থক্য দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে মরুভূমির একটি দেশ কীভাবে উন্নত বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। একটা সময় যারা মৎস্যজীবী ছিল সময়ের ব্যবধানে আজ তারা দুনিয়ায় অন্যতম ধনী জাতি এবং বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com