শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ অপরাহ্ন

মনপুরা দ্বীপে ঘোরাঘুরি

  • আপডেট সময় রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩
প্রকৃতির এক অনবদ্য আয়োজন। স্বপ্নের মতো সাজানো কিংবা তারও চেয়ে সুন্দর। অথবা কল্পনায় আঁকা আল্পনা। যেখানে প্রকৃতির বিচিত্র দৃশ্যায়ন মাঝে মাঝে ধাঁধায় ফেলে দেয়। কখনো দ্বীপাঞ্চল,  কখনো বা বনাঞ্চল মনে হয়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার মোহনায় জেগে থাকা মনমাতানো এই জগতের নাম মনপুরা দ্বীপ।
 ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চে যাওয়া যায় মনপুরায়। এছাড়া ভোলার তজুমদ্দিন ঘাট কিংবা বেতুয়া থেকে সি ট্রাক ও লঞ্চ যোগে সহজেই পৌঁছানো যায় অপরূপ দ্বীপে।
দ্বীপ জেলা ভোলার একটি বিচ্ছিন্ন উপজেলা মনপুরা। অর্থাৎ দ্বীপের মধ্যেই আরেকটি দ্বীপ। ভোলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এর অবস্থান। যেখানে ছোট বড় ৮/১০টি চরে সবুজের বিপ্লব। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস। বিভিন্ন চরে প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে এই বনভূমি। দিনভর এখানে খেলা করে চিত্রা হরিণ। জোয়ারের সময় তারা চলে আসে লোকালয়ের কাছাকাছি।
মনপুরা দ্বীপে ঘোরাঘুরি
মনপুরা দ্বীপে ঘোরাঘুরি

মনপুরায় মন জুড়াবে ইলিশ ধরার দৃশ্য। জেলের জালে উঠে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি মাছ। ইলিশ ধরার রোমাঞ্চকর দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখতে হলে, সঙ্গী হতে পারেন জেলেদের। মনপুরার এই চারণভূমিতে আরো নজর কাড়ে মহিষের পাল। স্থানীয় ভাষায় মহিষ রাখার জায়গাকে বলা হয় বাথান। মজার বিষয় হলো, শত-শত মহিষকেই দেয়া হয়েছে আলাদা নাম। যাদের নাম ধরে ডাকলেই সাড়া দেয়।
বাথানির সাথে মহিষের এক অদ্ভুত মিতালীও নজর কাড়বে যে কারও। এদের জীবন সংসার ছোট্ট কুঁড়েঘরে। রান্না, ঘুম সবকিছু এক জায়গাতেই। সকাল থেকে দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, ক্লান্তিহীন জীবন তাদের। তবুও অমলীন হাসিমাখা মুখ। বাথানে প্রতিদিন শত-শত কেজি দুধ উৎপাদন হয়। সকাল থেকে গোয়ালারা ঘুরে-ঘুরে দুধ সংগ্রহ করেন। এরপর দুধ সরাসরি হাঁড়িতে চলে যায়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি রেখে দিলে হয়ে যায় দই। আর মনপুরাজুড়ে এই দইয়ের সুনাম দীর্ঘকাল ধরে। অতিথি আপ্যায়নসহ নানা অনুষ্ঠানে সবার প্রথম পছন্দ মহিষের দধি। উপহার হিসেবেও দই চলে যায় দেশের নানা প্রান্তে। মহিষের দুধ দিয়ে আরও বানানো হয় সুস্বাদু পনির ও ঘি।
মনপুরায় বিশাল আকারের এক ধরনের কুকুর দেখা যায়। বলা হয়, এই দ্বীপে যখন পর্তুগিজরা বাস করত, তখন তারাই এই জাতের কুকুর নিয়ে আসেন। এছাড়া ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে মনপুরার অপার সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করেন অনেকে। বিকেলে সূর্যের লাল আভার সাথে নদীর এক অদ্ভুত মাখামাখি। দ্বীপের এমন সব ছবি ভ্রমণপিয়াসীদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। এখানে না গেলে বোঝাই যাবে না কত সুন্দর তার রূপ।
মনপুরার চেয়ে চরকুকরি মুকরির সৌন্দর্যও কোনো অংশে কম নয়। অনেকে কুকরি মুকরিকে স্বপ্নের দ্বীপ বলেও আখ্যা দেন। যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। হাতছানি দিয়ে ডাকে টুকরো টুকরো নিবিড় বনভূমি। যেখানে রয়েছে, নানা রকম গাছপালা আর বুনো ফুলের সুবাস।
বর্ষায় কুকরি মুকরির প্রায় অর্ধেকই জলমগ্ন থাকে। ফলে সেসব স্থানে সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা জাতীয় গাছ প্রচুর জন্মে। জোয়ার এলে বনের ভেতরে পানি উঠে যায়। আর নেমে যায় ভাটার টানে। তখন হাঁটা যায় বনের ভেতর। তবে এ সময় শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে।
কুকুরি মুকরিতে বনায়নের শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জানমাল রক্ষায় সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় বনায়ন গড়ে তোলে বন বিভাগ। পরে সুন্দরী, গেওয়া, পশুরসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করা হয়। বনের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে অনেক খাল। ভাটার সময় সেখানে মাছ ধরেন জেলেরা। চোখে পড়বে ছোট-ছোট জলজ প্রাণি। মন মাতানো সবুজের ক্যানভাসে পাখির ওড়াউড়ি আর কিচিরমিচির, সব মিলিয়ে এক মায়াবী সৌন্দর্য পুরো কুকরি মুকরিজুড়ে। মেঘনার বুক চিরে বয়ে যাওয়া খাল বন অতিক্রম করে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। যেখানে ধু-ধু বালু আর সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ। চিকচিক বালু আর হালকা নীল জলরাশির মিতালী মুগ্ধ করবে যে কাউকে। নারিকেল বাগান থেকে উপভোগ করা যায় সূর্য ডোবার দৃশ্যও।
খালে ভাসতে ভাসতেই নজরে আসবে গোলপাতায় তৈরি কুঁড়েঘর। সহজ-সরল এসব মানুষের চাওয়াও খুব বেশি নয়। দিন পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে আবার নতুন ভোর। এ যেন ব্যস্ততাহীন, নির্ঝঞ্ঝাট, সাদামাটা জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণিরও আশ্রয় হতো। সেসব জায়গা পরিচিতি পেয়েছে মুজিব কিল্লা নামে। যার একটি চোখে পড়ে কুকুরি মুকুরির এই বনে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যায় সব ঋতুতেই। তবে শীতকালে এর রূপ যেন নতুন করে ধরা দেয়। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলে কুকরি মুকরিও হতে পারে পর্যটন শিল্পের নতুন দিগন্ত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। বিশেষ করে নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলে এর রূপ যেন আরও উজ্জ্বল। যে কারণে জীবনানন্দ দাশ, মৃত্যুর পরেও ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলায়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com