ইউরেশীয় দেশ কাজাখস্তান। অর্থাৎ এটি এশিয়া ও ইউরোপ—উভয় মহাদেশেই অবস্থিত। যদিও এর ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল ভিত্তি এশিয়ায়। এর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, দেশটি মুসলিমপ্রধান।
সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট একটি নতুন আইনে স্বাক্ষর করেন। গত ৩০ জুন পাস হওয়া এই আইন অনুযায়ী, দেশটিতে উন্মুক্ত জায়গায় মুখ ঢেকে রাখা পর্দা বা বোরকা পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ত তোকায়েভের এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কাজাখস্তানে অনেক নারী ঐতিহ্যগতভাবে নিকাব বা মুখ ঢাকা পর্দা ব্যবহার করেন।
জানতে ইচ্ছা হতেই পারে, আইনটি আসলে কী বলছে? রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, এই নতুন আইনে ‘মুখ শনাক্তকরণে বাধা দেয়’ এমন পোশাক পরে জনসমাগমস্থলে বা পাবলিক স্পেসে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনটি শিথিল করা হয়েছে। যেমন খারাপ আবহাওয়া, চিকিৎসার কারণে অথবা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় মুখ ঢাকা পোশাক পরা যাবে। এই আইনে ইসলাম বা ধর্মীয় পোশাক বিষয়ে সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। এটিকে কাজাখস্তানের বৃহত্তর আইনি সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ মূলত ইসলামিক পোশাককে পাশ কাটিয়ে, রঙিন ও অলংকারপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী কাজাখ পোশাককে উৎসাহিত করতে চান। তিনি জানান, এর মাধ্যমে দেশের জাতিগত পরিচয় আরও জোরদার করা সম্ভব। তোকায়েভ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মুখ ঢেকে রাখা কালো পোশাক পরার বদলে আমাদের উচিত জাতীয় শৈলীর পোশাক পরা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক জাতিগত পরিচয়কে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরে। তাই আমাদের এসব পোশাককে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।’
শুধু কাজাখস্তানেই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিকাব, বোরকা ইত্যাদি পোশাক জনপরিসরে নিষিদ্ধ করার প্রবণতা দেখা গেছে।
১ ফেব্রুয়ারি থেকে কিরগিজস্তানে রাস্তায় নিকাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘন করলে গুনতে হবে জরিমানা। ২০২৪ সালে তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমোন এমন একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক পোশাক উন্মুক্ত স্থানে পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে ২০২৩ সাল থেকে উজবেকিস্তানে পূর্ণ মুখ ঢাকা পর্দাযুক্ত পোশাক নিষিদ্ধ হয়েছে। এই আইন ভাঙলেও গুনতে হবে জরিমানা।
এই পদক্ষেপগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় পরিচয় জোরদারের কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যদিও এ বিষয়ে সমালোচনা রয়েছে।
কিরগিজস্তান
মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের জাতীয় সংসদে গৃহীত নতুন আইন অনুযায়ী, জনসমাগমস্থলে নিকাব পরলে প্রায় ২৩০ মার্কিন ডলার জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। দেশটির আইনপ্রণেতারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মতে, নিকাব পরার ফলে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণভাবে ঢাকা থাকে। এমন পরিস্থিতি জনসমাগমস্থলে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে দেশটির সরকার চায়, জনসমক্ষে প্রত্যেকের চেহারা দেখা যাক এবং সহজে চিহ্নিত করা সম্ভব হোক। দেশটির স্পিকার নুরলানবেক শাকিয়েভ বলেছেন, ‘এই আইন কিরগিজ সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।’
তবে এই নিষেধাজ্ঞা শুধু নিকাবের জন্য প্রযোজ্য। হিজাবের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হিজাব বা মাথার স্কার্ফ পরার অনুমতি থাকছে। কারণ, এটি মুখ ঢেকে রাখে না। স্পিকার শাকিয়েভ বলেন, ‘আমাদের মায়েরা ও বোনেরা ঐতিহ্যগতভাবেই মাথায় স্কার্ফ পরেন, যা আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের অংশ।’
তাজিকিস্তান
২০২৪ সালের ১৯ জুন তাজিকিস্তান জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ একটি আইন অনুমোদন করে, যা জাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকা সব পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমন পোশাককে সরকার ইসলামিক পোশাক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আইনটি ইসলামিক পোশাককে ‘ফরেন ক্লদিং’ বা ‘এলিয়েন গার্মেন্টস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশটির সরকারের মতে, মৌলবাদ ও বিদেশি ধর্মীয় প্রভাব প্রতিরোধের পদক্ষেপ এটি।
তাজিকিস্তান ৯৬ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ। কিন্তু এখানে সরকার ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর ভিত্তি করে শাসন পরিচালনা করে। তাজিকিস্তানে নিকাব, হিজাব, মুখ ঢাকা পোশাকসহ দেশের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন সব পোশাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখার প্রয়াস এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের প্রতিফলন। আইনের লঙ্ঘনকারীদের জন্য রয়েছে বড় ধরনের জরিমানা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতাদের ওপরও প্রযোজ্য।
উজবেকিস্তান
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর, উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি শাভকাত মির্জিয়োয়েভ এক নতুন আইন স্বাক্ষর করেন। যেখানে পাবলিক স্থানে মুখ ঢেকে রাখার (যেমন বোরকা, নিকাব) পোশাক পরা নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়। ব্যক্তিকে শনাক্ত করা কঠিন হওয়া এড়াতে এই আইন পাস করেছে দেশটি। আইন অনুযায়ী, ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তে বাধা দেয় এমন পোশাক পরার জন্য ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন উজপর কিংবা ৪০০ থেকে ৮১০ মার্কিন ডলার জরিমানা করার কথা বলা হয়। এখানেও চিকিৎসার কারণ, কর্মক্ষেত্রগত প্রয়োজনে; যেমন ওয়েল্ডিং মাস্ক, আবহাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সিভিল ডিফেন্সের কাজে মুখ ঢাকা অনুমোদিত আছে।
সূত্র: এমএসএন