প্যারিস এক স্বপ্নের শহর। বিশ্বের সবচেয়ে বেশীসংখ্যক পর্যটকের গন্তব্যস্থল এই আলোকিত প্যারিস শহরে, প্রতিবছর প্রায় ৩ কোটি ট্যুরিস্ট আসে এই শহর ভ্রমণ করতে। দুই হাজার বছরেরও বেশি ঐতিহ্যের অধিকারী এই নগরী বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্যারিসের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আইফেল টাওয়ারের পাশাপাশি প্যারিসে রয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সদর দপ্তর, লুভ্যর জাদুঘর, যেখানে অনেক ঐতিহাসিক জিনিসের পাশাপাশি প্রদর্শিত আছে লিউনার্দো দ্য ভিঞ্জির পৃথিবী বিখ্যাত চিত্রকর্ম “মোনালিসা”; নডরডেম ক্যাথেড্রাল, স্যাক্রে ক্যর, লুক্সেমবার্গ গার্ডেন, লুক্সেমবার্গ প্যালেস, প্যালেস দ্য ভার্সাইলিস, ডিজনিল্যান্ডসহ আরো অনেক কিছু। এমন পৃথিবী বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান তো অনেক দেশেই রয়েছে, কিন্তু এত এত পর্যটক কেন শুধু প্যারিস ঘুরতেই আসে সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ঘুরে আসতে হবে প্যারিস শহরে।
আমাদের ইউরোপ ট্যুরের প্রধান আর প্রথম শহর ছিল প্যারিস। এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যাম্পাসের ছোট ভাই বোন প্রাপ্তি মানিকের আগমন। চারিদিকে সব অপরিচিত মানুষের মাঝে হঠাৎ ওদের হাসিখুশি মুখটা দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়৷ এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে করে যেতে যেতে আমাদের আড্ডা আর গল্পে কেটে যায় মুহুর্তগুলো৷ প্যারিসের মেট্রো সার্ভিস অসাধারণ। দুইজনের প্রথম একসাথে বিদেশ ভ্রমণ, এয়ারবিএনবি, ইউরোপ, মেট্রো, সবকিছুই আমাদের জন্য নতুন। হয়তো সবকিছু গুছিয়ে বুঝতে বুঝতে অনেক সময় লেগে যেত, কিন্তু ছোট ভাই বোন দুটির সহায়তায় সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমাদের এয়ারবিএনবিতে। আমাদেরও এমন ভাগ্য, ওইদিন ছিল প্যারিসের ‘হোয়াইট নাইট’ (Nuit Blanche)। যা কিনা প্যারিসের একটা আর্ট ফেস্টিভ্যাল। সাধারণ দিনে মেট্রো সার্ভিস রাত ১২ঃ৪০ এ বন্ধ হয়ে গেলেও এই দিনে সারারাত মেট্রো চলে, সব আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়ামগুলো অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে, সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা মাস্তি আর উৎসবে মেতে থাকে। সব মিলিয়ে এক জমজমাট উৎসবমূখর রাত। এত উৎসবমূখর আলো ঝলমলে প্যারিস দেখে মুহুর্তেই আমাদের এত লম্বা জার্ণির ক্লান্তি উবে যায়। এই রাত মিস করা কোনভাবেই উচিৎ হবেনা। তাই ব্যাগ রেখেই বের হয়ে যাই রাতের প্যারিস দেখতে। অনেক রাত পর্যন্ত চলে সেন নদীর পাড়ে বসে আইফেল টাওয়ার দেখতে দেখতে আমাদের আড্ডা।
পরেরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, রাস্তার দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে দাড়ানো ম্যাপল ট্রি এর ফাঁকে ফাঁকে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টি। ইউরোপে আমাদের প্রথম প্রহর। বিছানায় শুয়ে এমন সুন্দর মিষ্টি একটা সকাল উপভোগ করতে করতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে পড়বো৷ যেই কথা সেই কাজ, তৈরি হয়ে বের হয়ে যাই। কিন্তু বের হয়ে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। শুরু হয় আমাদের প্যারিস দেখা।
প্যারিস শহরটি ঘুরে দেখার জন্য আছে মেট্রো, হিপ হপ বাস, এছাড়া সেন নদীতে ক্রুজে করে ঘুরে প্যারিসের বেশিরভাগ পর্যটন স্থানগুলোতে যাওয়া যায়। তবে কোন শহর সুন্দরভাবে ঘুরে দেখার জন্য হাটার কোন বিকল্প নেই। স্পটগুলো কাছাকাছি থাকলে হেটে হেটে দেখতে দেখতে গেলে বেশি উপভোগ করা যায়। তাছাড়া সেন নদীর তীর ঘেষে হাটতে হাটতে প্যারিসের সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতাটাই একদম অন্যরকম।
আমাদের জন্য খোদ প্যারিসই ছিল মূল আকর্ষণ, তাই গদবাধা দর্শনীয় স্থানগুলো আলাদা করে তেমন গুরুত্ব পায়নি আমাদের কাছে। প্যারিসে ডে ট্রাভেল পাস কিনে নিলে সেটা দিয়ে বাস, ট্রেন, মেট্রো সবগুলোর জন্য আর আলাদা করে টিকিট কেনার ঝামেলা নেই। এছাড়াও ট্যুরিস্টদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরণের প্যারিস পাস, যেটা কিনে নিলে বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট প্লেস আর মিউজিয়ামগুলোতে প্রবেশ করা যায়। তাই পছন্দানুযায়ী ডে পাস কিনে নিলে একবারেই সময় বাচিঁয়ে ইচ্ছামতো সব ঘোরা যায়। আমরা আগে থেকেই ডিসিশন নিয়েছিলাম কোন মিউজিয়ামে ঢুকবো না, শুধু লুভ্যরে ঢুকে “মোনালিসা” দেখে আসবো। কারণ মিউজিয়ামগুলোতে ঢোকার লাইন এত বড় থাকে যে অনেক সময় নষ্ট হয়। এত অল্প সময়ে তাই প্যারিসকে ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য মিউজিয়ামগুলো স্কিপ কিরার সিদ্ধান্তটা ভালোই ছিল।
প্যারিসে হোটেল খরচ অনেক বেশি। তাই এয়ারবিএনবি হতে পারে ভালো একটা অপশন। হোটেলের মত কমার্শিয়াল ব্যাপার এখানে নেই। এছাড়া একটা ভিনদেশী পরিবারের সাথেও ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে আর ওদের লাইফস্টাইল সম্পর্কেও অনেককিছু জানা সম্ভব হয়, এটাও অনেক ভালো একটা অভিজ্ঞতা৷ আমাদের এয়ারবিএনবি এর হোস্ট ছিল ‘লৌলু’ নামের একজন ব্ল্যাক মহিলা। তার ছোট কজি এপার্টমেন্টটা ছিল ছিমছাম করে সাজানো। দিন শেষে রুমে ফিরে আরাম করে ড্রয়িং রুমের কজি সোফায় শুয়ে টিভি দেখার মজাটাই ছিল অন্যরকম, মনে হয়েছে একটা প্যারিসিয়ান পরিবারে বেড়াতে এসেছি, বাসা বাসা একটা অনুভূতি। আমাদের থাকার সময় হোস্ট উপস্থিত না থাকলেও তার ভাতিজি আমাদেরকে সুন্দরভাবে ওয়েলকাম জানায়৷ তার ইংরেজীর দক্ষতা কম হওয়ায় বুঝতে অনেকক্ষণ সময় লেগেছে সে আমাদের হোস্ট নয় বরং তার ভাতিজি। তার কাছ থেকে আমাদের নতুন শেখা শব্দ “উইফি” (ওয়াইফাই) , এই শব্দের অর্থ বুঝতে বুঝতে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে ফ্রেঞ্চ ভাষায় যে ‘ওয়াই-ফাই’ এর উচ্চারণ ‘উইফি’ এটা জানা ছিল না।
প্যারিসের বেকারি আইটেম পৃথিবী বিখ্যাত৷ এদের জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম বাগেট, যেটা আসলে লম্বা দেখতে একটা পাউরুটি। এমন শক্ত একটা সামান্য পাউরুটিও যে টেস্টি হতে পারে, তা এটা না খেলে বোঝা সম্ভব না। এটা দিয়েই প্যারিসের কর্মজীবী লোকেরা দিন পার করে দেয়৷ আমাদের মত খাবার অপচয় করেনা ওরা৷ একটা বাগেট একবারে খাওয়া শেষ করা সম্ভব না, তাই একটু খেয়ে বাকিটা তারা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে, পরে খাওয়ার জন্য।
আমরা প্যারিস শহরকে বলি ‘ভালোবাসার শহর’। এখানে ভ্রমণ করার আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার জন্য এই শহর। কিন্তু প্যারিসের অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি, প্যারিস আসলেই ‘ভালোবাসার শহর’, তবে তা প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা না, “এই শহরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা”। ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শিক্ষা, বিনোদন, গণমাধ্যম, পোষাকশৈলী সবদিক থেকেই প্যারিসের গুরুত্ব ও প্রভাব একে দিয়েছে অন্যতম বিশ্বনগরীর মর্যাদা। প্যারিসের প্রেমে পড়তেই হবে, ফিরে আসতে ইচ্ছা করবে বার বার৷
শেষ দিন সারাদিন ঘুরে আমরা প্যারিসের শেষ সময়টুকু কাটাতে আবারো চলে যাই ট্রোকাডেরোতে, যেখানে বসে আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় কয়েকগুণ বেশি। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যায়, এবার ফিরতে হবে, আসার সময় আমি বার বার পেছন ফিরে শুধু তাকাই আইফেল টাওয়ারের দিকে, বিদায় জানাতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, শহরটায় অন্যরকম একটা মায়া আছে। যেতে চাই, বার বার যেতে চাই এই এই মায়াভরা শহরে।
লিখেছেন – নুরুন্নাহার সুমি