রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

ভাললাগার পথচলা

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪

ঘণ্টাসাতেক গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম অ্যারিজ়োনার টুসন শহরে। পরের দিন টুসন থেকে নিউ মেক্সিকোর কার্লসবাদ শহরে পৌঁছে যাব আবার ঘণ্টাসাতেক ড্রাইভ করে। আলবুকার্কিতে আছে নুতন ও পুরনো শহর, প্রাকৃতিক বিস্ময় ১১৯টি ছোট-বড় গুহা, সাদা বালির পাহাড়, গোস্ট টাউন। নিউ মেক্সিকো মরুভূমির উপর গড়ে ওঠা একটি রাজ্য। শীতের বেশির ভাগ দিনই বর্ষা ও বরফ পড়ার পূর্বাভাস থাকে। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে গেলে সীমান্ত পেরোবার সময় পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।  তাই হাতে পাসপোর্ট, গ্রিন কার্ড, সিটিজ়েনশিপ কার্ড রাখা অত্যন্ত জরুরি।

অ্যারিজ়োনার বর্ডারে আর্মির লোকেরা সদা বর্তমান। দাঁড় করিয়ে যাবতীয় জিনিস চেয়ে বসল, পরীক্ষা করতে যে আমরা আমেরিকায় বসবাসকারী বৈধ মানুষ কিনা বা মাদক পাচার করছি কিনা? বর্ডার ক্রসিংয়ে ঢোকার মুহূর্তে ক্যামেরার ঝলকানি। বিদ্যুতের গতিতে গাড়িসমেত আমাদের ছবি উঠে গেল, কুকুর বাবাজি গাড়ির সামনে এসে গন্ধ শুঁকে দেখে নিল। সব সেরে আমরা টুসনে হোটেলে এসে উপস্থিত হলাম।

টুসন থেকে কার্লসবাদ ক্যাভার্নসের দূরত্ব, ছ’ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। দুপুর ঘনিয়ে বিকেল আসন্ন। হঠাৎ চোখে পড়ল এল পাসো টেক্সাস ও আমেরিকার বর্ডারে তৈরি ওয়াল, যা আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের নির্দেশের সাক্ষ্য বহন করছে। এল পাসো, টেক্সাস থেকে কার্লসবাদ, মেক্সিকো যেতে কিছুটা রাস্তা আছে, যা জনমানবশূন্য, খাবার বা গ্যাস স্টেশন নেই। তাই গাড়িতে গ্যাস ভরে চলতে শুরু করলাম। শীতকাল, তাই সূর্যদেব আলোর আস্ফালন না দেখিয়ে বিদায় নিয়েছেন, সন্ধ্যার হাত ধরে রাতটাও বেশ ঘন হতে শুরু করেছে আমেরিকার রাস্তায়। সেই রাতটুকু অ্যারিজ়োনাতে থেকে পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম নিউ মেক্সিকোর উদ্দেশে।

পরের দিন আমাদের গন্তব্য, নিউ মেক্সিকোর কার্লসবাদ ক্যাভার্নস। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে উপস্থিত হলাম ভিজ়িটর সেন্টারে। উপর থেকে গুহা কত বড়, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। গুহার উপরেই ভিজ়িটর সেন্টার। গুহা পরিদর্শন করতে টিকিট লাগে। রেঞ্জার জানালেন, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ গুহা কক্ষ। ঘণ্টাদেড়েক পরিভ্রমণ করে গুহায় প্রবেশ করা যায়। আর একটি পথ হল, লিফটে করে ৭৫০ ফিট নীচে নামিয়ে দেবে গুহার কেন্দ্রে।

লিফটে করে হুস-হুস করে নেমে পড়লাম গুহা কেন্দ্রে, অর্থাৎ বৃহৎ কক্ষে। বিস্ময় কাটিয়ে উঠলাম। প্রবেশদ্বারের সামনেই আছে অনেকটা জায়গা, যেখানে কিছু খাবারের দোকান ও ছোট ছোট গিফট শপ আছে। আর রয়েছে বসে খাওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা, মহিলা ও পুরুষদের ব্যবহারের জন্য বাথরুম।

আলো-আঁধারির মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লাম পৃথিবীর বৃহত্তম ভূগর্ভস্থ কক্ষে। সমগ্র গুহাটি দেখতে সময় লাগে সাড়ে তিন থেকে চারঘণ্টা। আর শুধু বড় কক্ষটি দেখতে সময় লাগে দেড়ঘণ্টা। কেভের বেশিরভাগ অংশই লাইমস্টোন।  লম্বায় ৪০০০ ফিট, ৬২৫ ফিট প্রস্থে এবং উচ্চতায় ২২৫ ফিট। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দেখা যাবে স্ট্যালাকটাইটস ও স্ট্যালাকমাইটসের সৌন্দর্য। এগুলো দেখতে একটা অন্যটার চেয়ে আলাদা, তাই নামকরণ হয়েছে ভিন্ন রূপে। যেমন উইচেস ফিঙ্গার, ডেভিলস ডেন, ডল থিয়েটার, চাইনিজ় থিয়েটার… আছে ছোট ছোট অনেক লেক, যাদের সৃষ্টি মাটির থেকে চুঁইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জলে। এর সৃষ্টি, বুনন ও কারুকার্যর কাছে মানুষের তৈরি শিল্প দাঁড়াতে পারে কিনা, এ প্রশ্ন মনে জাগবেই।

গুহার ভিতরে হাঁটার জন্য আছে ট্রেল, তাতে ছোট ছোট আলো লাগানো। পথচারীদের চলার সুবিধার্থেই এই ব্যবস্থা। তবে গুহার সৃষ্টিতে হাত দেওয়া একদম মানা। ট্রেলের বাইরে যাওয়াও নিষেধ। গুহার নীচে অনেক প্রাণির বাস। তাদের শান্তিতে যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, তাই জোরে কথা না বলাই ভাল। এই গুহা দেখার সঠিক সময় হল মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এই গুহার আর একটি বিশেষত্ব হল, প্রচুর পরিযায়ী বাদুড়ের দর্শন মেলে এখানে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে থাকে। এরপর শীত পড়ে যায় বলে ওরা উড়ে চলে যায় অন্য কোনও গরমের জায়গায়। সে দৃশ্য নাকি ভারী সুন্দর!

ঘণ্টাদুয়েকের গুহাভ্রমণ শেষ, ভিজ়িটর সেন্টারে ফিরে যখন এসেছি, তখন মাঝ-দুপুর। কিছু খাবার কিনে আমরা পথ চলা শুরু করলাম নিউ মেক্সিকোর রাজধানী আলবুকার্কির উদ্দেশ্যে।

রাত ন’টা নাগাদ আলবুকার্কি এসে পৌঁছলাম। চেক-ইন করার সময় এক বয়স্ক ভারতীয় মহিলা বেরিয়ে এলেন। এই হোটেল সংলগ্ন বাড়িতেই উনি থাকেন। জানতে পারলাম, হোটেলের কাছে রেস্তরাঁ ও ফাস্ট ফুডের দোকান আছে। রাতের বা দিনের আহার ওখান থেকেই করতে হবে। ব্রেকফাস্ট হোটেল থেকেই দেওয়া হয়, কাজেই চিন্তার কিছু নেই।

সেই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরের দিন আমাদের গন্তব্য ছিল গোস্ট র‌্যাঞ্চ। গুগল সার্চ করে দেখলাম, অনেক উঁচুতে পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি বিস্তীর্ণ জায়গা। আছে কিছু পরিত্যক্ত বাড়ি, একটি মিউজ়িয়াম ও একটি চার্চ। মনে হল, কিছু রহস্য যেন লুকিয়ে আছে। মনে টানটান উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালবেলা কিছু খাবার ও জল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ি পথে চলতে গেলে জল ও খাবার সঙ্গে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এসব পথে দোকান চোখে প্রায় পড়েই না বলা চলে। আবার পাহাড়ি পথ, তার উপর বরফ পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। পাকদণ্ডী পথ দিয়ে যেতে যেতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল, সময় তখন সকাল এগারোটা। আকাশ কালো করে এসেছে, তুলোর মতো সাদা বরফের টুকরো গাড়ির কাছে পড়ে, কাচ ঝাপসা করে দিচ্ছে। যত উপরের দিকে উঠছি, ততই বরফ পড়া বেড়ে যেতে লাগল। রাস্তার একদিকে তুষারাবৃত পাহাড়, মাঝে মাঝে একটা দুটো সবুজ গাছ উঁকি দিচ্ছে। রাস্তার অন্যদিকে রিয়ো গ্রান্দে রিভার, পাহাড় ও রাস্তার বুক চিরে ইতিউতি বয়ে চলেছে। এই রিয়ো গ্রান্দে রিভার নিউ মেক্সিকোর অনেক জায়গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে। নদীটি বিখ্যাত হয়ে গেল রাতারাতি, যখন মেক্সিকো থেকে আমেরিকা আসার সময় এক বাবা তাঁর বছরতিনেকের বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে, খরস্রোতা নদী পেরিয়ে চলে আসার চেষ্টা করেছিলেন আমেরিকায়, মেক্সিকোর অসংখ্য অত্যাচারিত জনগণের মতো। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। স্রোতে বাচ্চাটি ভেসে যায়, এবং পরে  নদীর পাড়ে তাকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যে দৃশ্য পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেককেই দেখলাম ছবি তুলতে। পাহাড়ের উপর থেকে নদীটি দেখতে খানিকটা দড়ির মতো। নদীর জলে পড়ছে বরফের টুকরোরা। অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম  গোস্ট র‌্যাঞ্চে। নির্জন দুপুর। মাঝে মাঝেই হালকা বৃষ্টি আর ইলশেগুঁড়ি হাড়ে কাঁপুনি লাগিয়ে দিচ্ছে। ইনফরমেশন সেন্টার সংলগ্ন গিফট শপ ও বেকারি রয়েছে। প্রবল ঠান্ডার দরুণ বেকারি দুপুর দেড়টার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখান থেকে টুরের ব্যবস্থা রয়েছে। গিফট শপে যে ভদ্রমহিলা কাজ করেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। কথায় কথায় জানতে পারলাম, বিকেল পাঁচটার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে না পারলে বেশ গা ছমছম করে। অন্ধকার যত বাড়ে, এই গোস্ট র‌্যাঞ্চ এক অন্য মাত্রা নেয়। গিফট শপ সংলগ্ন চার্চে নিয়মিত ধর্মপ্রাণ মানুষেরা আসেন। চার্চের এককোণে রাখা আছে পিয়ানো, সার দিয়ে সাজানো দর্শক আসন। আছে একটি ব্যালকনি। ব্যালকনির ব্যবস্থা বাড়তি লোকেদের জন্য। এখানে গরমের সময় চার্চ ক্যাম্প হয়। চর্চা করা হয় প্যালিওন্টোলজি ও অ্যানথ্রোপোলজির। ইচ্ছে ছিল প্রকৃতির এই পাঠশালায় আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানোর, কিন্তু প্রবল তুষারপাত শুরু হওয়ায় গোস্ট র‌্যাঞ্চকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশে।


পরের দিন আমাদের গন্তব্য হোয়াইট স্যান্ডস ন্যাশনাল পার্ক। এটি বিস্ময়কর, কারণ ঢেউখেলানো সাদা বালির বালিয়াড়ি প্রথম দর্শনে মনে হয়, বিস্তীর্ণ সাদা বরফ। অনেক হাজার বছর এটি ছিল একটি বেসিনের অংশ। যা টুলারোসা বেসিন নামে পরিচিত ছিল। এই বেসিনে ছিল বড় লেক, সবুজ ঘাসের জমি। পরিবেশ গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি ও তুষারপাত আশপাশের পাহাড় থেকে জিপসাম দ্রবীভূত করে ছড়িয়ে দেয় বেসিনের উপর। প্রবল বাতাস ও ধুলো ঝরে জিপসাম পাথর ভেঙে স্তূপাকৃত হতে থাকে বেসিনের উপর।

পার্কের ভিতর গাড়ি পার্ক করার জায়গা আছে। গাড়ি পার্ক করে, পার্কের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করতে ভীষণ ভাল লাগবে। রয়েছে বালির পাহাড়ও। ভাড়া পাওয়া যায় ছোট ছোট প্লাস্টিকের গামলা, যার মধ্যে বসে উপর থেকে নীচে স্রোতের গতিতে নেমে আসা যায়। এই অনাবিল আনন্দের সাক্ষী হতে আমিও পিছপা হইনি।

হলিউড পরিচালকদের খুব পছন্দের এই জায়গায় তৈরি হয়েছে প্রচুর কমার্শিয়াল, ফিচার ফিল্ম, ফ্যাশন ক্যাটালগ, ও মিউজ়িক ভিডিও। ‘স্টার ওয়ার্স’ মুভিটি এখানেই তৈরি হয়েছিল।

এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে চলতে চলতে ঘন নীল আকাশের মাঝখানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। মিটিমিটি তারারা ছবি আঁকে হোয়াট স্যান্ডস এর গায়ে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com