সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের ম্যানগ্রোভ বন। ইউনেস্কো হেরিটেজের এই স্থানটি ‘ভারতে ঘূর্ণিঝড়ের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। কলকাতা থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। জেলাটির নাম দক্ষিণ ২৪ পরগণা। প্রতি ২০ মাসে গড়ে একবার ঘূর্ণিঝড় হয় এখানে। এর ফলে পুরো দেশের ওপর একটি খারাপ প্রভাব ফেলে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ঐতিহাসিকভাবে এসব বাজে আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এই বন ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস সহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা প্রতিরোধ করে। এ খবর দিয়ে লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলছে, এখানে বসবাসকারীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মৌসুমি এসব ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘন ঘন এমন ঝড় হচ্ছে। এর কারণ জলবায়ু বিষয়ক সংকট। ২০২১ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস তীব্র শক্তি নিয়ে আঘাত হানে এ অঞ্চলে। এখানে মাটিতে তৈরি বেশির ভাগ বাড়ি। এমন বাড়ির সংখ্যা তিন লাখ। তার মধ্যে তারা নামে এক নারীর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিণাতে তা ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে তারা’র (ছদ্মনাম) পরিবারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে। বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনধারাও পাল্টে গেছে। এর ফলে ১১ বছর বয়সী তারাকে পাচার করা হয় যৌনতায়। বলতে গেলে তাকে বানানো হয় যৌনদাসী।
তারার পিতা ড্রাইভার হিসেবে কাজ খুঁজে পেতে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে বাধ্য হন। তারার বয়স যখন ৬ বছর তখন তার মা মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড়ে ওই গ্রামটি পুরোপুরি পানির নিচে চলে যায় কয়েকদিন। ফলে তারা বা তার দাদীর অবস্থান করার মতো কোনো স্থান ছিল না। এ অবস্থায় তারা খুব কাছাকাছি থাকেন এমন এক আন্টির সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। তারার বিয়ে হয়ে যায়। তার স্বামী তাকে সঙ্গে রাখতে বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু সবার চোখে এটা ছিল একটি ভুল বিচার। তারার দাদীর নাম আরাভি (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে তারাকে অপহরণ করা হয়।
পাচার করা হয় ১৬০০ কিলোমিটার দূরে দিল্লিতে। সেখানে তাকে দেহব্যবসা করতে বাধ্য করানো হয়। এ বিষয়ে তারা বলেন, একদিন আমার আঙ্কেল আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যান। তিনি আমাকে চাপাড়ি এবং লাড্ডু খেতে দেন। তা খাওয়ার পর আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। যখন হুঁশ ফেরে নিজেকে দেখতে পাই একটি ট্রেনের ভিতর। খুব ভয় পেয়ে যাই। দিল্লিতে নিয়ে আমাকে একটি বাড়িতে রাখা হয়। ওই বাড়িটি ছিল বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ বাইরের কোনো মানুষের সঙ্গে ওই বাড়ির কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমার সঙ্গে কি ঘটেছে তাও আমি বুঝতে পারলাম না। পাচার বলতে কি বুঝায় তাও আমি জানি না।
তারা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকেন, তারা আমাকে দেহব্যবসায় বাধ্য করে। এতে বাধা দিয়ে আমি কাঁদতে থাকি। কিন্তু যতই কাঁদি তারা আমাকে ততই প্রহার করে। এমনকি আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে, আমাকে পাচার করা হয়েছে। শুধু বাড়ির কথা মনে হচ্ছিল।
ওদিকে তারাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার দাদী আরাবি। তিনি বলেন, তাকে ছাড়া আমি যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রতিটি স্থানে খুঁজেছি। পুলিশে গিয়েছি। সবার সহায়তা চেয়েছি। কিন্তু কেউ তাকে আমার কাছে এনে দিতে পারেনি। এ অবস্থায় তিনি স্থানীয় একটি এনজিও গোরানবোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের (জিজিবিকে) সন্ধান পেয়ে যান। এই এনজিওটি পুলিশের সঙ্গে পাচার হওয়া নারী ও মেয়েদের উদ্ধারে কাজ করে। ওদিকে দিল্লিতে নিজের বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তারার। ওই বন্ধুটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তারার অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেন।
পাচারকারীরা থাকে অসম্ভব রকম সাবধান। তারা বুঝতে পারে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে এবং খুব শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এটা বুঝতে পেরে তারা এবং তার মতো অন্য মেয়েদেরকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত পাঠায় পাচারকারীরা। পশ্চিমবঙ্গে ফেরার পর তারা তার গ্রামে ফিরে যান। আরাবি বলেন, তারা এরই মধ্যে তার পবিত্রতা হারিয়েছে। তার মানসিক অস্থিরতা রয়েছে। তার যে ক্ষত, মানসিক, শারীরিক তাতে অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ে। নিজের চুল ছিড়ে খেতে থাকে। আরাবি বলেন, আমি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সেখানে তাকে কাউন্সেলিং দেয়া হয়। তার শরীরের ওপর যে পাশবিকতা চালানো হয়েছে, তার ক্ষত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। কি ঘটেছিল, তাও সে ঠিকমতো স্মরণ করতে পারছিল না।
জিজিবিকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সুভশ্রী রাপতান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ইস্যু। এর কারণে এ অঞ্চলের মানুষদের পাচার করা হচ্ছে। ইয়াস আঘাত করার পর তারার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে একটি পয়সাও ছিল না। সব কৃষিজমি চলে গিয়েছিল পানির নিচে। আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারার বাড়িও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তার পিতার জীবিকা নির্বাহের কোনো পথ ছিল না। এ জন্য তিনি গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন। চলে যান শহরে। যেহেতু তারা তার পিতামাতার নজরদারিতে ছিল না, তাই কথিত আত্মীয় এই সুবিধা নিয়েছে। তাকে পাচার করেছে। দিল্লি ভিত্তিক লিঙ্গগত বিষয়ে গবেষণা করেন সিজিআইএআরের অবণী মিশ্র। তিনি বলেন, নারী এবং পুরুষরা ভিন্ন ভিন্নভাবে দুর্ভোগের শিকারে পরিণত হন। আমাদের গবেষণা বলে যে, নারী এবং শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তন, চরমভাবাপন্ন প্রাকৃতিক জলবায়ু বিষয়ক ইভেন্টের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এটা ঘটে এ জন্য যে, এক্ষেত্রে আছে লিঙ্গগত অসমতা। জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে এগুলো খুব প্রকটভাবে ঘটে।
অবণী মিশ্র বলেন, চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর কারণে যদি একজন মা মারা যান, তার সন্তানরা বিপন্ন হয়ে পড়ে। এর দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অথবা তিনি তাদেরকে বোঝা মনে করেন। এ জন্য তাদেরকে পাচার করা হয়, বিক্রি করা হয় অথবা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। আবার যদি কোনো পরিবারের পিতা মারা যান, তখন নারীর ওপর বিরাট চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায়। তিনি একা ও বিধবা হয়ে পড়েন। সন্তানদের দেখভাল তার জন্য হয়ে পড়ে চ্যালেঞ্জের।
সরকারি হিসাবে মহামারিকালে ভারতে শতকরা ২৮ ভাগ পাচার বেশি হয়েছে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ২১৮৯। এমনই পাচারের শিকার রহিমা খান (১৩)। ২০১২ সালে তাকে পাচার করেছিল প্রতিবেশীরা। তিনি বলেন, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। পাচারকারীরা আমার পথে একটি সেতুর ওপর অপেক্ষায় ছিল। তারা আমাকে অপহরণ করে একটি গাড়িতে তোলে। আমি আর্ত চিৎকার শুরু করলে, তারা আমার মুখে কিছু একটা স্প্রে দেয়। এতে আমি অচেতন হয়ে পড়ি। যখন চেতনা ফেরে তখন আমার চারপাশে সব দেখে চিৎকার করতে যাই। কিন্তু আমি শব্দ করতে পারছিলাম না।