ভারতীয় ভিসা প্রদান বন্ধ থাকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের এয়ারলাইন ও পর্যটন খাতে। তবে এর ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশি পর্যটকের প্রবাহ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের তথ্যানুসারে, ভারতীয় ভিসা দেওয়া যখন বন্ধ হয়েছে, ঠিক তখনই শুরু হয়েছে পর্যটনের মৌসুম। এ কারণে ওইসব দেশে অবকাশ যাপনকালীন পর্যটকের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে বেড়েছে বিমান ভাড়াও। বিশেষ করে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো কিছু দেশের বিমান ভাড়া বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
তবে এয়ারলাইনগুলো বলছে, সরাসরি ভিসা বন্ধ হওয়ার কারণে বিমান ভাড়া বাড়েনি। তারা বলছে, সাধারণত সরবরাহর অনুপাতে জোগান এবং টিকিট কেনার সময়ের মতো সাধারণ কারণেই ভাড়া বেড়েছে।
আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের সভাপতি হাসানুজ্জামান রনি বলেন, ‘একদিকে ট্যুরিস্ট সিজন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় অন্য রুটগুলোতে পর্যটকের প্রবাহ বেড়েছে। এছাড়া ইউরোপের ভিসা প্রাপ্তির জন্য অনেকে ভারতের বিকল্প হিসেবে নেপালকে বেছে নিয়েছেন।’
টিকিটের দাম বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নেপালের রাউন্ড ট্রিপ টিকিট আগে ২৫-৩০ হাজার টাকা ছিল, যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যদিও অন্যান্য রুটে যাত্রী বেড়েছে, তবে ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় যে পরিমাণ ব্যবসা কমেছে সেটা এখনো পোষানো যায়নি।’
দূরত্বের দিক দিয়ে ভারতের পর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে কাছের পর্যটন গন্তব্য হলো নেপাল। দেশটিতে বর্তমানে ঢাকা থেকে দুটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও নেপালের হিমালয়া এয়ারলাইন্স। এই দুই এয়ারলাইন্সই বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ফ্লাইট পরিচালনা করে।
এয়ারলাইন্স দুটি জানিয়েছে, তাদের ফ্লাইটগুলোতে ৮০ শতাংশের বেশি আসন পূর্ণ থাকছে। যাত্রীদের অধিকাংশই পর্যটক। বাকিরা কাঠমান্ডু হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কাগামী এক পর্যটক বলেন, রাউন্ড-ট্রিপ টিকিটের দাম প্রায় ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু শ্রীলংকার নিয়মিত ভাড়া সাধারণত ৪২ হাজার থেকে ৫৩ হাজার টাকার মধ্যে থাকে।
সোমবার শেয়ারট্রিপ-এ ১৯ নভেম্বর শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের ঢাকা-কলম্বো রাউন্ড-ট্রিপ ফ্লাইটের জন্য টিকিটের মূল্য ছিল ১.১২ লাখ টাকা। অন্যদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার ট্রানজিট ফ্লাইটের টিকিটের দাম ছিল ৪৮ হাজার ৭১৪ টাকা।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ-এর (টোয়াব) তথ্যমতে, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, ভৌগোলিক নৈকট্য এবং সহজে ভিসা পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পর্যটকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল ভারত। দেশের মোট পর্যটকের ৪০-৪৫ শতাংশই ভারতে যেতেন।
তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত ভিসা প্রদান বন্ধ রাখলে পরিস্থিতি বদলে যায়। যদিও ভারত সীমিত পরিসরে ফের ভিসা প্রদান শুরু করেছে, তবু সংখ্যায় সেটি খুবই কম। এতে ভারতীয় রুটে যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে।
যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি এয়ারলাইন্স ভারতে তাদের ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে বা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার বাংলাদেশ-ভারত রুটে ঢাকা-কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই এবং মুম্বাইয়ে রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া ভারতের ভিস্তারা এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো বাংলাদেশ-ভারত রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে। নভোএয়ার সম্প্রতি তাদের কলকাতা ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত নামিয়ে এনেছে।
অ্যামেজিং ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী মহসিন ইকবাল বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার ১০ শতাংশ হতো ভারতে। কিন্তু ভারত ভিসা বন্ধ করার পর আমরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারিনি। তবে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশে পর্যটক যাওয়ার হার বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে থাইল্যান্ডে ট্যুরিস্ট বেড়েছে। অন্যান্য এজেন্সি নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রভৃতি গন্তব্যে ট্যুরিস্ট বেশি পাঠাচ্ছে।’
টিকিটের দামও বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার গন্তব্যগুলোতে রাউন্ড-ট্রিপ টিকিট ৬০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ভুটানের টিকিট ৫০ হাজারে বিক্রি হচ্ছে।
‘বেশ কিছু জনপ্রিয় গন্তব্য, যেমন দুবাই, সিঙ্গাপুর ও উজবেকিস্তানে ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। থাইল্যান্ডের ভিসা পেতেও এক মাস লেগে যাচ্ছে।’
কিছু পর্যটন গন্তব্যে ভাড়া বাড়লেও এয়ারলাইন্সগুলো জানিয়েছে, যেসব পর্যটক পরিকল্পনা করে অগ্রিম টিকিট কিনে রাখেন, তাদেরকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় না।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতীয় ভিসা বন্ধ হওয়ার পর থেকে আমাদের মালদ্বীপ ও ব্যাংকক রুটে যাত্রী অন্তত ১০ শতাংশ বেড়েছে।
‘এখন কেউ যদি একদিন আগে টিকিট কাটেন, তাহলে তো বেশি দামে কিনতে হবেই। তবে যারা প্ল্যান করে ঘোরাফেরা করেন, তারা অন্তত এক মাস আগেই টিকিট কিনে ফেলেন।’
বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনকেন্দ্রিক দেশগুলোর মধ্যে কাঠমান্ডু, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) বুশরা ইসলাম বলেন, ‘ভারত ছাড়া অন্য রুটগুলো, যেমন কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে আমাদের যথেষ্ট যাত্রীর চাপ আছে। তবে আমরা হঠাৎ বিমান ভাড়া বাড়াইনি; ভাড়া যেভাবে ওঠা-নামা করে ওইভাবেই চলছে।’
টোয়াবের তথ্যানুসারে, চিকিৎসা পর্যটন, কেনাকাটা ও অবকাশযাপনের জন্য বাংলাদেশি পর্যটকদের ১৫-২০ শতাংশ থাইল্যান্ডে যায়। মালয়েশিয়ায় যায় ১০-১৫ শতাংশ ও সিঙ্গাপুরে যায় ৫-১০ শতাংশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ওমানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের পর্যটকদের ১০-১৫ শতাংশ এবং ইউরোপে ৫-৮ শতাংশ পর্যটক যায়। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যায় ৫-৮ শতাংশ পর্যটক।
অন্যদিকে বাংলাদেশি পর্যটকদের মধ্যে ২-৫ শতাংশ যায় উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়।
সুত্র: টিবিএস