বলছি ভুটানের কথা। প্রথম পর্বে জেনেছেন, ভুটানের পুরুষরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। অথচ বাঙালি প্রথা অনুযায়ী, বিয়ের পর নারীরা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। দর্শনীয় স্থান হিসেবে ভুটান বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এ দেশের রাজা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে, তবুও তিনি পুরো দেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি।
আপনি ভ্রমণে শুধু একদল পর্যটকদের সঙ্গে যেতে পারবেন। সমস্ত নথী এবং ভিসা একটি রাষ্ট্র নিযুক্ত কোম্পানি দ্বারা ইস্যু করা হয়। পারোমিক পেতে আপনাকে অগ্রিম সমস্ত খরচ দিতে হবে।
যেমন- ফ্লাইট টিকেট, হোটেল ফি, ট্যুর অপারেটর এবং গাউড পরিষেবা। ভিসা এমনকি বিমা দেশটিতে আপনি শুধুমাত্র একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন। আপনার নিজে নিজে কোথাও ঘোরার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে পড়াশুনা করতেন। তাই বাঙালিদের জন্য তাদের হৃদয়ে রয়েছে বিশেষ স্থান। আর যে কঠোর নিয়মগুলোর কথা বললাম, সেগুলো মূলত ইউরোপিয়ানদের জন্য। কেননা তারা চায় না যে, ভুটানে ইউরোপিয়ান কোনো অনাকাঙ্খিত সংস্কৃতি ঢুকে পড়ুক।
একমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই দেশটিতে ফ্রি ভিসা পান। অর্থাৎ আপনি যদি বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে এই দেশে যেতে আপনাকে কোনো ঝামেলাই পোহাতে হবে না। সেখানে ঘুরতে গিয়ে কোনো কারণে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে আপনি দেখবেন সেখানকার ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে সব কর্মচারী মেয়ে।
তখন আপনি হয়তো ভাববেন, আপনি কোনো মহিলা হাসপাতালে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু না, সেখানে নারী-পুরুষ সব রকমের রোগী দেখতে পাবেন আপনি। আসলে এদের বেশিরভাগ হাসপাতাল নারীরা চালান। শুধু কি হাসপাতাল? হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলে দেখবেন, দোকানপাটও চালাচ্ছেন নারীরা।
হোটেলের মালিক, যানবাহনের ড্রাইভার, রান্নার কুকসহ যাবতীয় কাজে নারীরাই সর্বেসর্বা। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, পরিবারের, বাড়ির, গবাদি পশু এবং জমির মতো সব সম্পত্তির মালিকানা পায় পরিবারের বড় মেয়েরা।
এতো কিছুর মাঝে তো আসল কথাটাই বলা হয়নি। ভুটান পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে বিবেচিত। আসলে ভুটানে জীবনযাপনের মান বিচার করা হয় ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ দ্বারা। অন্যান্য দেশের মতো গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্টের মাধ্যমে নয়।
দেশটির সরকার জনগণের বস্তুগত ও মানসিক শান্তির কথা বলেন। এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয় দেশটির গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস সেন্টার থেকে। এই সংস্থা একজন মানুষ পরিচালনা করেন। অধিকাংশ ভুটানবাসী তার জীবন নিয়ে বিরাট সুখী।
এই দেশটিতে জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে সাত লাখ। ভূ-খণ্ড ৩৮ হাজার ৩৬৪ বর্গ কিলোমিটার। প্রধান ভাষা জঙ্ঘা। রাষ্ট্রীয় ধর্ম বৌদ্ধ। এছাড়া হিন্দু ধর্মও রয়েছে। ভুটানিদের গড় আয়ু পুরুষদের বেলায় হয় ৬৬ বছর। আর নারীদের হয় ৭০ বছর। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিং। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ তান্ডি দরজি। তারা দুজনই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করেছেন।
গোটা দেশটিতে কোনো রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। এছাড়াও নেই কোনো নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী। দেশটির প্লাইমলেট খুবই নিম্ন। এমনকি আপনি আরো একটি বিষয় জেনে অবাক হবেন, ১৯৯৩ সাল থেকে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয় এই দেশে। ভাবুন তো, কতটা পরিবেশবান্ধব দেশ হলে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
আরেকটি অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভুটানে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টিভি এবং ইন্টারনেট আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবে আধুনিক প্রযুক্তি থেকে সমগ্র দেশকে আলাদা করা অসম্ভব ছিল। তাই রাজা এই নিয়ম বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন। এই ক্ষেত্রে ভুটান টেলিভিশন ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের শেষ দেশ।
এখন চলুন, এদেশের মানুষের পোশাক সম্পর্কে জানা যাক। অন্য দেশ থেকে এতো ভিন্ন একটি দেশ, তাদের জামা-রকাপড় ভিন্ন হবে না তা কি করে হয়? ভুটানের মানুষেরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন। পুরুষেরা ভারী পোশাক পরেন এবং নারীরা লম্বা পোশাক পরেন।
একজন ব্যক্তির অবস্থা এবং সামাজিক স্তর তাদের বাম কাঁধে আবৃত স্কার্ফের রং দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত মানুষ সাদা স্কার্ফ পরেন। ধনী মানুষ এবং ভিক্ষুকরা হলুদ রঙের পোশাক বেশি পরেন। তাই আপনার একটু বুঝতে কষ্ট হতে পারে এখানে কে ধনী আর কে গরিব।
তারা সবাই নিজেদের সংস্কৃতিকে অনেক ভালোবাসেন। তাই তো ভুটানের রাজা সতর্ক করে দিয়েছেন, টিভি আর ইন্টারনেটের প্রভাবে যেন ভুটানের সংস্কৃতি হারিয়ে না যায়। জনগণও দেশের রাজাকে দারুণ ভালোবাসেন। নাচ-গান তো তাদের অনেকেরই পছন্দ।
আপনি জানলে অনেক অবাক হবেন, এই দেশটিতে কারো জন্মদিন পালন করা হয় না। এমনকি এখানকার কোনো মানুষের নিজেদের জন্মদিন মনেই থাকে না। কেননা ভুটানদের মতে, শুধু জন্মের দিনটা স্পেশাল হবে না। আর তাই বছরের একটি দিনে তারা সবাই মিলে সবার জন্মদিন একসঙ্গে উদযাপন করেন।
যদিও ভুটানে এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। সংসদের অধিকাংশ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত। সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ রয়েছে। তবে সুপ্রিম পাওয়ার এখনো রাজার হাতেই এবং রাজ পরিবার এখনো উচ্চ আসনে আসীন।
এমনকি আরেকটি মজার কথা কি জানেন? তরুণ বয়সে রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক সে দেশে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ছিলেন গোলকিপার। একদিন রাজা খেয়াল করলেন, তার দল গোল দেয়। তবে কখনো গোল খায় না।
পরে তিনি জানতে পারেন, বিপরীত দলের সবাই এই ভেবে গোল খেয়েই যাচ্ছে যে, গোলকিপার তো রাজা। তাই রাজার সম্মান রক্ষার্থে কেউ গোলই দিতে আসেন না। গোলপোস্টের সামনে বল এনে বল অন্য দিকে পাঠিয়ে দেয়।
আর এটি তিনি যে দিনই জানতে পারলেন, সেদিন থেকেই তিনি ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি চান না কেউ তার জন্য এভাবেই হেরে যান। ভাবুন তো, দেশের মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এমনটা করা যায়। ভুটানে আধুনিকতার ছোঁয়া এখনো তেমন লাগেনি। তারপরও দেশটির জনগণ ভীষণ খুশি। তাদের কাছে সুখের গুরুত্বই সর্বোপরি।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে ভুটান সবচেয়ে আলাদা। দুর্নীতি, অপশাসন, নোংরা রাজনীতি, জাতিগত হানাহানি, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, ব্যাংক লুট এগুলো ভুটানকে স্পর্শ করতে পারেনি।
আমরা কথায় কথায় এতদিন বলে এসেছি, গণতান্ত্রিক দেশ বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। এখন বলার সময় এসেছে, ভুটান থেকে আমাদের আসল শিক্ষা নেয়া উচিত।
তারা একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই যাচ্ছে। ভুটান আমাদের সামনে সত্যিই এক অনুসরণীয় মডেল। সেখানে সবকিছুই চলে নিয়ম-শৃঙ্খলা আর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। তাদের দেশপ্রেম এমনকি রাজনীতিও যে কাউকে মুগ্ধ করবে।