এক দেশ থেকে অন্যান্য দেশকে আলাদা করে সীমান্ত–আন্তর্জাতিক সীমানা। সীমান্ত শুধু ভূখণ্ডকে ভাগ করে না, এটা এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের আইনি সীমাও নির্ধারণ করে। একটি দেশের অধিকারভুক্ত অঞ্চলকে চিহ্নিত করে দেয় সীমান্ত। সীমান্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এই সীমারেখা একটি দেশ ও দেশের মানুষের পরিচয় গড়তে সাহায্য করে। মানুষ ও পণ্যের সীমান্ত পারাপার নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে এসব বিভাজনরেখা। ভূপ্রকৃতি, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভূরাজনৈতিক কারণে একেক সীমান্তের চরিত্র একেক রকম হয়। এসব বৈশিষ্ট্য ও দৈর্ঘ্যের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ১০টি সীমান্ত নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।
আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করা ঐতিহাসিক জিব্রালটার প্রণালি দেশ দুটিকে আলাদা করেছে, আর তাই মরক্কো-স্পেন সীমান্তটি বিশেষভাবে অনন্য। জিব্রালটার প্রণালির সবচেয়ে সরু অংশ চওড়ায় মাত্র ১৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এটি আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক সীমানাপ্রাচীর।
সীমান্তটি মরক্কোর তানজিয়ের ও স্পেনের তারিফার মতো শহরের মাধ্যমে দুই মহাদেশের বাণিজ্য, পর্যটন, সংস্কৃতির বিনিময়ে সহায়তা করে। জিব্রালটার প্রণালীর অতি কাছে হওয়ায় এ সীমান্ত আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপত্যশৈলী, খাবারদাবার আর সংস্কৃতি যেমনটা বলছে, সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে স্পেন ও মরক্কো উভয় দেশের প্রভাব রয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো প্রজাতন্ত্রের একটি সান মারিনো। দেশটি আষ্টেপৃষ্ঠে ইতালির ভূখণ্ড দিয়ে বেষ্টিত। সান মারিনো-ইতালি সীমান্তের অনন্যতা হচ্ছে, এটি ইতালির পেটের মধ্যে আলাদা একটি দেশকে চিহ্নিত করে। দুর্গম অ্যাপেনাইন পর্বতমালার ভেতর দিয়ে যাওয়া এই সীমান্তের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৯ কিলোমিটার। সান মারিনো ও ইতালির ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের ভাষা ও মুদ্রা এক। সীমান্তটি একটি খোলা সীমান্ত। দুই দেশের মানুষ ও পণ্য অবাধে এটা পারাপার করতে পারে।
স্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি সীমান্তে তিনটি দেশ একটি বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। তিনটি দেশের এক সীমান্ত বিশ্বে খুব একটা দেখা যায় না। আর তাই এটা বিশেষভাবে অনন্য। মধ্য ইউরোপে অবস্থিত এই সীমান্ত এলাকাটি যুগ যুগ ধরে সংস্কৃতি ও ভাষার আদান-প্রদান এবং বাণিজ্য–পথের একটি কেন্দ্র হয়ে রয়েছে। এই সীমান্তরেখা বিচিত্র ভূপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে গেছে। একদিকে স্লোভাকিয়ার ঢেউখেলানো পাহাড়, অন্যদিকে আলপাইন পাহাড়ের পাদদেশ, আরও একদিকে হাঙ্গেরির উর্বর সমভূমি। তিন দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ায় এটা ইইউর একটি অন্তর্গত সীমান্ত।
এটা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত সীমান্তগুলোর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৬০ মিটার উঁচু থেকে শুরু হয়ে এ সীমান্ত ছুঁয়ে গেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া মাউন্ট এভারেস্টের ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার উঁচু শিখরকে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম এলাকাগুলোর মধ্য দিয়ে যেমন এই সীমান্ত গেছে, তেমনি এর পথে পথে রয়েছে প্রকৃতির সুন্দরতম দৃশ্যপট। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ এ সীমান্ত। নেপাল ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও দুর্গম হিমালয় এলাকায়। এই সীমান্ত হিমালয় অঞ্চলের আন্তবাণিজ্য এবং যাতায়াত-যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে সিল্ক রোডের জন্য।
স্থলবেষ্টিত ছোট দেশ লেসোটু। দেশটিকে ঘিরে রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এটি বিশ্বের অল্প কয়েকটি ছিটমহলের একটি। লেসোথোর আগের নাম বাসুটুল্যান্ড। দেশটির রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার সমৃদ্ধ ইতিহাস। দেশটি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয়েছে ১৯ শতকে। লেসোথো-দক্ষিণ আফ্রিকা সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৯০৯ কিলোমিটার। এই সীমান্তরেখা পাহাড়-পর্বত, মালভূমি, উপত্যকাসহ বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির মধ্য দিয়ে চলে গেছে। ছোট এই দেশ বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো খাতে বৃহৎ প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর একান্ত নির্ভরশীল। দুই দেশের মধ্য ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাজার এবং বিনিয়োগ থেকে লাভবান হচ্ছে লেসোথো। দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। আছে সীমানা-পেরোনো সাংস্কৃতিক লেনদেন।
এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এ সীমান্ত প্রায় ৮ হাজার ৮৯১ কিলোমিটার লম্বা। পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। জলপ্রপাত, পাহাড়-পর্বত, বন, নদী, হ্রদ, সমভূমিসহ বিচিত্র ভূপ্রকৃতির ভেতর দিয়ে এই সীমান্তরেখা চলে গেছে। এটিকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে ‘দীর্ঘ অরক্ষিত সীমান্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ আখ্যা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতার সম্পর্কের কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে যানবাহন, কৃষি, জ্বালানি, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য আর লেনদেনের বড় সম্পর্ক আছে। এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্কগুলোর একটি।
এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অপরিবর্তিত সীমান্তগুলোর একটি। ১২৯৭ সালে আলকানিসেস চুক্তির মাধ্যমে স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে যে সীমানা নির্ধারিত হয়, তা এখনো বহুলাংশে বহাল। পশ্চিমে আটলান্টিক উপকূল থেকে পূর্বে পিরেনিজ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত এ সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২১৪ কিলোমিটার। দুটি দেশ বহু শতাব্দী ধরে ইতিহাস, ভাষা ও রীতি-প্রথার অংশীদার। উভয় দেশেরই রয়েছে সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সীমান্ত অঞ্চলের ঐতিহাসিক শহর, ইউনেসকো ঘোষিত ঐতিহাসিক স্থান এবং অপূর্ব স্থাপত্যকীর্তিগুলোতে দুটি দেশের অভিন্ন অতীতের ছাপ দেখা যায়। স্পেন ও পর্তুগাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এবং শেনজেন অঞ্চলে অবস্থিত। তাই দুই দেশের নাগরিক ও পণ্য এ সীমান্ত দিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারে।
উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত সীমান্তগুলোর একটি। কোরীয় বেসামরিক অঞ্চল (ডিমিলিটারাইজড জোন-ডিএমজেড) নিয়ে এ সীমান্ত গড়ে উঠেছে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর কোরিয়া যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত এই বেসামরিক অঞ্চল কোরিয়া উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত হওয়ার প্রতীক হিসেবে গণ্য। বেসামরিক অঞ্চলে চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। শুধু নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ব্যক্তিদের এবং কূটনৈতিক উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়ার সীমিত অনুমতি দেওয়া হয়। এ সীমান্তে কোরীয় উপদ্বীপের এই দুই প্রতিবেশীরই সামরিক উপস্থিতি প্রবল। দেশ দুটি সীমান্তের দুই পাশে সেনা মোতায়েন করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদসহ ঘাঁটি গেড়ে কড়া পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে। বেসামরিক অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা কোরিয়া যুদ্ধসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। এর মধ্যে আছে পানমুনজং, যেখানে দুই কোরিয়ার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তি হয়েছিল।
ছিটমহল ও মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের (এনক্লেভ ও এক্সক্লেভ) জটিল বিন্যাস নেদারল্যান্ডস-বেলজিয়াম সীমান্তের বড় বৈশিষ্ট্য। এটা বিশেষ করে বোঝা যায় বেলজিয়ামের বারলে-হারটগ পৌরসভা এবং নেদারল্যান্ডসের বারলে-নাসাউ পৌরসভার ক্ষেত্রে। বারলে-হারটগ/বারলে-নাসাউ আসলে একটি শহর। শহরটি বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। সীমান্তের এই বিশেষ পরিস্থিতি পর্যটকদের যেমন বারলে-হারটগ/বারলে-নাসাউ ছিটমহলে টেনে আনে, তেমনি অঞ্চলটির সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহর ও গন্তব্যও ঘুরে দেখতে আকৃষ্ট করে। কয়েক শতাব্দী ধরে নানা চুক্তি ও ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের সীমানা রূপান্তরিত হয়েছে। দুটি দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য। এটা তাই ইইউর অন্তর্গত সীমান্ত হিসেবে গণ্য। এ কারণে দুই দেশের মানুষ, পণ্য ও পরিষেবা অবাধে এ সীমান্ত পারাপার করতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ–নদীগুলোর জটিল সীমানা এ দুই দেশের সীমান্তকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। বিশেষত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার জলধারা দুটি দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সীমানা টেনে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ স্থলসীমানাগুলোর একটি। মোটামুটি ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সীমান্ত বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘ স্থলসীমান্ত। দুই দেশের আন্তসীমান্ত ব্যবসা-বাণিজ্য উল্লেখ করার মতো। এই সীমান্ত দিয়ে বিশেষ করে কৃষিপণ্য, তৈরি পোশাক ও শিল্পজাত পণ্যের বাণিজ্য চলে। ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশটির বাকি অংশের স্থলপথে যোগাযোগে সীমান্তটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ সীমান্তে ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত টহলের জন্য উভয় দেশের আলাদা বাহিনী আছে।
তথ্যসূত্র: গ্রিকসফরগ্রিকস